উপমহাদেশের কিছু বস্তুবাদী দর্শন [পর্ব - দুই]
চার্বাক:
চার্বাক মতবাদ একই সঙ্গে নিরীশ্বরবাদী, অনাত্মাবাদী ও ভূতবাদী। ভারতের প্রথম বস্তুবাদী চিন্তার প্রতিফলন হয়েছিল চার্বাক মতবাদে। এই দর্শনের আরও একটা নাম বস্তুবাদী দর্শন। প্রাচীন বস্তুবাদী মতবাদের নামটা নিয়ে একটু আলোচনা স্বল্প পরিসরে সেরে নেওয়া যাক।
'চার্বাক' কথাটা কোথা থেকে এলো? অনেক দার্শনিকের মতে 'চারু+বাক্' থেকে চার্বাক কথাটা এসেছে। মানুষের স্বাভাবিক ভোগ প্রবৃত্তির কথা যে মতবাদ 'চারু' বা সুন্দর করে বলে, তাই চার্বাক মতবাদ। চার্বাক মতে, ইহ জগতেই সব কিছুর শেষ। মৃত্যুর পরে অন্য জগৎ বলে কিছু নেই। অতএব ভোগ করো।
অন্য মতে 'চর্ব' (অর্থাৎ চর্বণ) করে যে - এই অর্থে চার্বাক শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। এই ধরনের ব্যাখ্যায় তাঁরা বলতে চান চর্ব-চোষ্য খানা-পিনার মধ্যেই জীবনের চরমতম সার্থকতা যে মতবাদ খুঁজে পায়, তার-ই নাম চার্বাক দর্শন। ব্যাকরণ মানতে গেলে দুটো মতকেই বাতিল করতে হয়। 'চারু+বাক্' থেকে 'চারুবাক্' অথবা 'চারবাক্' বা 'চার্বাক'-এর 'ক'-এ হসন্ত বাদ দেওয়া হয়েছে। আবারে 'চর্বণ করে যে' সে 'চার্বাক' নয় 'চার্বক', অর্থাৎ 'ব'-এ আ-কার হবে না।
পালি সাহিত্য বিষয়ে সুপণ্ডিত রিস ডেভিডস (Rhys Davids)-এর মতে মহাভারতের এক কুচরিত্র রাক্ষস চার্বাক-এর নাম থেকেই ভাববাদীরা বস্তুবাদী মতবাদটির নাম রাখেন চার্বাক দর্শন। মহাভারতে আছে - চার্বাক ছিল দুর্যোধনের বন্ধু আর এক দুরাত্মা। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ বিজয়ী ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরকে ব্রাহ্মণ ছদ্মবেশধারী চার্বাক জ্ঞাতিঘাতী হিসেবে ধিক্কার জানিয়ে আত্মঘাতী হতে প্ররোচিত করেছিল। কিন্তু উপস্থিত ব্রাহ্মণগণ তাঁদের অতীন্দ্রিয় ক্ষমতায় চার্বাক-এর আসল পরিচয় জেনে ফেলে যুধিষ্ঠিরকে রক্ষা করেন।
প্রাচীন ভাববাদীরা বস্তুবাদী মতবাদটির প্রতি সাধারণ মানুষের অশ্রদ্ধা ও ঘৃণা সৃষ্টির জন্যই এমন এক ঘৃণ্য রাক্ষস চরিত্রের নামে মতবাদটির নাম রেখেছিলেন। সে যুগের কিছু ভাববাদী, চার্বাক বা লোকায়ত মতবাদকে দেবগুরু বৃহস্পতি প্রণীত বলে উল্লেখ করেছেন। পুরাণে আছে - অসুরদের পরাক্রমে বিধ্বস্ত দেবকুলকে রক্ষা করতে এক কৌশল অবলম্বন করলেন বৃহস্পতি। অসুরদের ধ্বংসের জন্য, অধ:পাতে নিয়ে যাওয়ার জন্য এই ভ্রান্ত মতবাদ রচনা করলেন। তারপর অসুরের ছদ্মবেশে অসুরদের মধ্যে বস্তুবাদী দর্শনটি প্রচার করলেন। ফলে নীতিভ্রষ্ট, ভ্রান্ত অসুররা দেবতাদের কাছে পরাজিত হলো।
এখানেও দেখতে পাই বস্তুবাদী চার্বাক মতবাদ-ই অসুরদের ধ্বংসের কারণ হয়েছিল - এই রকম প্রচারের মধ্য দিয়ে বস্তুবাদী দর্শনের প্রতি আতঙ্ক এবং বিদ্বেষ সৃষ্টির চেষ্টা স্পষ্ট।
শঙ্করাচার্য প্রমুখ ভাববাদী দার্শনিকেরা এই বস্তুবাদী মতবাদকে 'লোকায়ত' নামে অবহিত করার কারণ হিসেবে জানিয়েছেন - দর্শনটি ইতর লোকের দর্শন, তাই 'লোকায়ত' দর্শন। এখানে ভাববাদী দার্শনিকদের লোকায়ত মতবাদের প্রতি অশ্রদ্ধা স্পষ্ট।
অনেক পাঠক-পাঠিকার মনেই এ চিন্তা নিশ্চয়ই উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে, চার্বাক বা লোকায়ত মতবাদে কী এমন কথা বলা হয়েছে, যা অবহেলায় পাশে সরিয়ে দেওয়ার সাধ্য সে যুগের রথী-মহারথী দর্শনিকদের ছিল না (যদিও প্রকৃত অর্থে তাঁরা কেউ-ই 'দার্শনিক' ছিলেন না।) যার ফলে ভাববাদী রথী-মহারথীরা বস্তুবাদী এই খণ্ডিত দর্শনটিকে লক্ষ্য করে তীক্ষ্ণ আক্রমণ হেনেছেন। সেই সঙ্গে সাধারণ মানুষদের দর্শনটি থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে নানাভাবে আতঙ্ক সৃষ্টির চেষ্টা করেছেন। সাধারণ মানুষের মধ্যে যুক্তিবাদী চিন্তার বিরুদ্ধে আতঙ্ক সৃষ্টি করতে 'রামায়ণ', 'মহাভারত'-এর মতো মহাকাব্যগুলোতে ঢুকে পড়েছে অনেক কাহিনী, অনেক নীতিকথা। রামায়ণের অযোধ্যা কাণ্ডের দিকে তাকান। রামচন্দ্র তখন চিত্রকূটে। ভরত এলেন। রামচন্দ্র ভরতকে রাজ্য পরিচালন বিষয়ে উপদেশ দিতে গিয়ে বললেন,
ক্কচিন্ন লোকায়তিকান্ ব্রাহ্মণাংস্থাত সেবসে।
অনর্থকুশলা হোতে বালা: পণ্ডিতমানিনঃ।।
অর্থাৎ "আশা করি তুমি লোকায়তিক ব্রাহ্মণদের সেবা করছ না। ওরা অনর্থ ঘটাতে খুবই পটু।”
মহাভারতের শান্তিপর্ব। এক ধনী বণিক রথে যাওয়ার সময় এক ব্রাহ্মণকে ধাক্কা মারে। ক্ষুব্ধ ব্রাহ্মণ অপমানের জ্বালা ভুলতে আত্মহত্যার কথা চিন্তা করে। দেবরাজ ইন্দ্র ব্রাহ্মণের আত্মহত্যার মধ্যে সর্বনাশের সংকেত দেখতে পেয়ে শিয়াল সেজে হাজির হলেন। ব্রাহ্মণকে পশু জীবনের বহু কষ্টের কথা বলে মানব জীবনের জয়গান গাইলেন। জানালেন, অনেক জন্মের পূণ্যের ফল সঞ্চল করে এই মানব জন্ম পাওয়া। এমন মহার্থতম মানব জীবন, বিশেষত শ্রেষ্ঠ মানুষ হিসেবে ব্রাহ্মণ হয়ে জন্মলাভের পরেও কেউ কি পারে সে জীবন ধ্বংস করতে? অভিমানে আত্মহত্যা করা মোটেই বুদ্ধিমানের কাজ নয়। শিয়াল, সে নিজেও আগের জন্মে ব্রাহ্মণ হয়েই জন্মেছিল। কিন্তু সে জন্মে চূড়ান্ত মূর্খের মতো এক মহাপাতকের কাজ করেছিল বলেই আজ এই শিয়াল জন্ম।
চূড়ান্ত মূর্খের মতো মহাপাতকের কাজটা কী? এবারই বেরিয়ে এলো নীতিকথা-
অহমাংস পণ্ডিতকো হৈতুকো দেবনিন্দকঃ।
আন্বীক্ষিকিং তর্কবিদ্যম্ অনুরক্ত নিরার্থিকাম।।
হেতুবাদান প্রবদিতা বক্তা সুংসৎসু হেতুমৎ।
আক্রোষ্টা চ অভিবক্তা চ ব্রাহ্মবাক্যেষু চ দ্বিজান্।।
নাস্তিকঃ সর্বশঙ্কী চ মূর্খঃ পণ্ডিতমানিক:।
ভাস্য ইয়ং ফলনিবৃত্তিঃ শৃগালত্বং মম দ্বিজ।।
(শান্তিপর্ব ১৮০/৪৭-৪৯)
অর্থাৎ, আমি ছিলাম এক বেদ সমালোচক তার্কিক পণ্ডিত। নিরর্থক তর্কবিদায় ছিলাম অনুরক্ত। বিচারসভায় ছিলাম তর্কবিদ্যার প্রবক্তা। ভক্তিবলে দ্বিজদের ব্রহ্মবিদ্যার বিরুদ্ধে আক্রোশ মেটাতাম। ছিলাম জিজ্ঞাসু মনের নাস্তিক, অর্থাৎ কিনা পণ্ডিতাভিমানী মূর্খ। হে ব্রাহ্মণ, তারই ফলস্বরূপ আমার এই শিয়ালজন্ম।
ভারতবর্ষে অধ্যাত্মবাদী বা ভাববাদী দর্শনের সুস্পষ্ট প্রকাশ দেখতে পাই আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে 'উপনিষদ' সাহিত্যে। চার্বাক বা লোকায়ত দর্শন বা বস্তুবাদী যুক্তিবাদের সুচনা সঠিক কবে হয়েছিল বলা সম্ভব নয়। অনুমানিক অষ্টম শতকে রচিত বৌদ্ধ দার্শনিক কমলশীলের ব্যাখ্যা গ্রন্থ 'পঞ্জিকা'তে বস্তুবাদী চার্বাক মতবাদের উল্লেখ রয়েছে দেখতে পাই।
কমলশীলের গুরু শান্তরক্ষিত নিজের মতের সমর্থনে 'তত্ত্বসংগ্রহ' নামে একটি দর্শনগ্রন্থ রচনা করেন। তাঁর রচনায় দেখতে পাই বস্তুবাদী যুক্তি-তর্ক নির্ভর মতবাদকে তিনি 'চার্বাক' না বলে 'লোকায়ত' বলে বর্ণনা করেছিলেন।
শান্তরক্ষিত থেকে শঙ্করাচার্য পর্যন্ত বেশ কয়েকজন বিখ্যাত অধ্যাত্মবাদী বা ভাববাদী দার্শনিকের রচনায় 'লোকায়ত' বা 'চার্বাক' নামের যুক্তি-তর্ক নির্ভর মতবাদটির উল্লেখ আছে। সেসময় ভারতীয় দর্শনের প্রথা মতো পরমত খণ্ডন করে নিজের মত স্থাপন করা হতো। পরমত হিসেবেই এইসব ভাববাদী দার্শনিকেরা চার্বাক বা লোকায়ত মতবাদের বিভিন্ন মতের উল্লেখ করেছেন। আর সেই উল্লেখ থেকেই আমরা চার্বাক দর্শন বিষয়ে কিছু তথ্য জানতে পারি। চার্বাক বা লোকায়ত দর্শন ছিল সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের দর্শন, যা ছড়া হিসেবে প্রচলিত ছিল মানুষের মুখে মুখে। অলিখিত এই ছড়াই লোকগাথার রূপ পেয়েছিল।
আত্মা অবিনশ্বর হলে তবেই মৃত্যুর পর আসে স্বর্গ বা নরক ভোগের প্রশ্ন; জন্মান্তর, পূর্বজন্মের কর্মফল ইত্যাদি প্রশ্ন। আত্মা নশ্বর হলে এইসব প্রশ্ন-ই অর্থহীন হয়ে যায়।
চার্বাক বা লোকায়ত দর্শনে আত্মার বিষয়ে এমন কিছু যুক্তির অবতারণা করা হয়েছিল যেগুলো ইতরজন বা সাধারণের কাছেও গ্রহণীয় হয়ে উঠেছিল।
চার্বাক দর্শনে আত্মা বা চৈতন্যকে দেহধর্ম বলে বর্ণনা করা হয়েছে। আর এই বক্তব্যই ভাববাদী দার্শনিকদের কাছে চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। বস্তুবাদী চার্বাক দর্শনের সঙ্গে ভাববাদী দর্শনের সুদীর্ঘ লড়াই চলেছিল শুধুমাত্র আত্মা 'অমর' কি 'মরণশীল' - এই নিয়ে।
লোকায়ত দর্শন মতে - কোনও সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর জন্য প্রমাণের প্রয়োজন। বিশ্বাস নির্ভর অনুমানের সাহায্যে সিদ্ধান্তে পৌঁছানো সম্ভব নয়। অনুমান নির্ভর, একান্ত বিশ্বাস নির্ভর অমর আত্মা, ইহলোক, পরলোক ইত্যাদি ধারণাগুলো লোক ঠকানোর জন্য একদল ধূর্ত লোকের সৃষ্টি।
প্রমাণের মধ্যে প্রত্যক্ষ প্রমাণই শ্রেষ্ঠ বলে চার্বাক দর্শন মনে করলেও প্রত্যক্ষ অনুগামী জ্ঞানকেও মর্যাদা দিয়েছিলেন তারা। অপ্রত্যক্ষ প্রমাণের ক্ষেত্রে প্রতিটি অনুমানের মূল শর্ত অবশ্যই হবে 'পূর্ব প্রত্যক্ষ', অর্থাৎ প্রত্যক্ষের ওপর নির্ভর করে অনুমান। যেমন ধোঁয়া দেখলে আগুনের অনুমান, গর্ভ দেখে অতীত মৈথুনের অনুমান ইত্যাদি। ভাববাদীদের চোখে প্রত্যক্ষ ও প্রতাক্ষ অনুগামী জ্ঞানের গুরুত্ব ছিল সামান্য অথবা অবান্তর। তাঁরা অনেক বেশি গুরুত্ব দিতেন 'ঋষি' নামধারী ধর্মগুরুদের মুখের কথাকে, ধর্মগুরুদের অন্ধ বিশ্বাসকে - যার ওপর নির্ভর করেই গড়ে উঠেছিল আত্মা সংক্রান্ত মতবাদ বা অধ্যাত্মবিদ্যা।
আজও যাঁরা বলেন, বিজ্ঞানের সঙ্গে ধর্ম এবং অধ্যাত্মবাদের কোন দ্বন্দ্ব নেই, বরং অধ্যাত্মতত্ত্বই 'পরম বিজ্ঞান', তাঁরা এটা ভুলে যান - প্রত্যক্ষ জ্ঞান বা অপ্রত্যক্ষ প্রমাণ ছাড়া প্রকৃত বিজ্ঞানের প্রথম ধাপটিতে পা রাখাই সম্ভব নয়। আরা 'অধ্যাত্মতত্ত্ব' দাঁড়িয়ে আছে 'আত্মা অমর' এই বিশ্বাসের উপর, যা বিজ্ঞান বিরোধী বিশ্বাস।
লোকায়ত দর্শন প্রত্যক্ষ ও প্রত্যক্ষ অনুগামী জ্ঞানের ওপর নির্ভর করে দ্বিধাহীন ভাষায় ঘোষণা করেছিল - চৈতন্য দেহেরই গুণ বা দেহেরই ধর্ম। দেহ ধ্বংস হওয়ার পর চৈতন্যস্বরূপ আত্মার অস্তিত্ব অজ্ঞান ও ধূর্তদের কল্পনা মাত্র। আর 'অধ্যাত্মতত্ত্ব' বা আত্মার অবিনশ্বরতার উপর নির্ভর করে গড়ে ওঠা তত্ত্ব বিজ্ঞানের লক্ষণ নয়; অজ্ঞানের লক্ষ্মণ।
লোকায়ত দর্শনের এই বক্তব্যের বিরুদ্ধে শঙ্করাচার্য যে যুক্তি রেখেছিলেন তা হলো - লোকায়তদের মতে দেহের মূল উপাদান জল, মাটি, আগুন, বায়ু ইত্যাদি ভূত পদার্থ। এই প্রতিটি ভূত পদার্থই জড় বা অচেতন পদার্থ। তাহলে এই অচেতন পদার্থে গড়া মানুষের মধ্যে চেতনা আসছে কোথা থেকে? আসছে নিশ্চয়ই এই সব অচেতন পদার্থের বাইরে থেকেই। অতএব স্বীকার করে নেওয়া উচিত - চৈতনা বা আত্মা দেহের অতিরিক্ত একটা কিছু। আত্মা বিষয়ে অন্যান্য বহু অধ্যাত্মবাদী দার্শনিক যেসব তর্কের ঝড় তুলেছেন, তাঁদের অনেকের বক্তব্যেই শঙ্করাচার্যের এই যুক্তির সুর লক্ষ্য করা যায়। তাঁরাও ঘুরিয়ে ফিরিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন - জড় বা অচেতন পদার্থে গড়া দেহ তো সরল যুক্তিতে অচেতনই হবার কথা। তবে মানুষের চৈতন্য আসছে কোথা থেকে?
লোকায়ত দর্শন এই যুক্তির বিরুদ্ধে পালটা যুক্তিও হাজির করেছে - মদ তৈরির উপকরণগুলোতে আলাদা করে কোন মদশক্তি নেই। কিন্তু সেই উপকরণগুলোকেই এক ধরনের বিশেষ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মিলন ঘটানোর পর সম্পূর্ণ নতুন এক গুণ পাওয়া যাচ্ছে, যাকে বলছি মদ। আত্মা বা চৈতন্যও একই জাতীয় ঘটনা।
লোকায়তিকদের চৈতন্যের সঙ্গে মদ শক্তির তুলনা নিয়ে কোন বিপক্ষ দার্শনিকই কূটতর্ক গড়ে তোলার চেষ্টা করেননি। তবে তাঁরা দৃষ্টান্ত হিসেবে এনেছেন মৃতদেহের তুলনা। চৈতন্য যদি দেহেরই লক্ষণ বা ধর্ম হয়, তবে মৃতদেহেও তো চৈতন্য থাকার কথা, থাকে না কেন?
লোকায়ত দর্শনের আত্মা বা চৈতন্যতত্ত্বের বিরুদ্ধে ভাববাদীদের এটাই সবচেয়ে জোরালোতম যুক্তি।
চার্বাক বা লোকায়ত দর্শন এর বিপক্ষে জোরালো কোনও যুক্তি হাজির করতে পারেনি। প্রাচীনকালের পটভূমিতে শারীরবিদ্যার অনগ্রসরতার যুগে এই ধরনের যুক্তির কোন উত্তর দেওয়া সম্ভব ছিল না। আজ বিজ্ঞানের তথা শারীর বিজ্ঞানের উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে আমরা অনেক কিছু জেনেছি। পরবর্তীকালে নিশ্চয়ই আরও অনেক কিছুই জানবো। যেটুকু জেনেছি, তারই ভিত্তিতে আমরা বলতে পারি দেহ ও মৃতদেহের ধর্ম সমান নয়। চিন্তা, চেতনা বা চৈতন্য মস্তিষ্কের স্নায়ুকোষের ক্রিয়া।
মৃতদেহের ক্ষেত্রে মৃতদেহেরই অংশ মস্তিষ্ক স্নায়ুকোষেরও যেহেতু মৃত্যু ঘটে তাই স্নায়ুকোষের ক্রিয়াও ঘটে না, ফলে মৃতদেহের ক্ষেত্রে চৈতন্য বা চিন্তা থাকে অনুপস্থিত।
লোকায়ত দর্শনে আত্মা, পরলোক এবং পারলৌকিক ক্রিয়াকর্ম নিয়ে এমন অনেক যুক্তি দেখানো হয়েছে, যেসব যুক্তি এ যুগের যুক্তিবাদীদেরও ঈর্ষা জাগাবার মতো। দু-একটা উদাহরণ তুলে দেওয়ার লোভ সামলাতে পারলাম না। মূল শ্লোক থেকে বাংলা তর্জমা করলে এমনটা দাঁড়ায়-
উদাহরণ ১: ব্রাহ্মণ জীবিকা হেতু তৈরি শ্রাদ্ধাদি বিহিত। এছাড়া কিছুই নয় জেনো গো নিশ্চিত।।
উদাহরণ ২: যদি, শ্রাদ্ধকর্ম হয় মৃতের তৃপ্তির কারণ।
তবে, নেভা-প্রদীপে দিলে তেল উচিত জ্বলন।।
উদাহরণ ৩: পৃথিবী ছেড়ে যে ভূতপদার্থে ফেরে
তার পাথেয় দিতে পিণ্ডদান বৃথা।
যেমন, ঘর ছেড়ে যে গ্রামান্তরে
তার পাথেয় (খাদ্যবস্তু) ঘরে দেওয়া বৃথা।।
উদাহরণ ৪: চৈতন্যরূপ আত্মার পাকযন্ত্র কোথা?
তবে তো পিণ্ডদান নেহাতই বৃথা।।
উদাহরণ ৫: যদি, জ্যোতিষ্টোম যজ্ঞে
বলি দিলে পশু যায় স্বর্গে।
তবে, পিতাকে পাঠাতে স্বর্গে
ধরে-বেঁধে বলি দাও যজ্ঞে।।
উদাহরণ ৬: ভণ্ডরা পশুর মাংস খেতে অজুহাত চান।
তাই তাঁরা দিয়েছেন বলির বিধান।।
বুদ্ধের যুগের পর চার্বাক দর্শনের বিকাশের কোনও খবর আমরা পাইনি। তার কারণ হতে পারে, (১) বৌদ্ধ দর্শন চার্বাক দর্শনের তুলনায় অনেক উন্নততর, সংঘবদ্ধ সাধারণ মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য দর্শন ছিল, (২) বৌদ্ধ দর্শনের আবির্ভাব ও বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় বৌদ্ধ অনুরাগীদের অগ্রগমন পিছিয়ে থাকা চার্বাক দর্শনকে আরও পিছিয়ে দিয়েছিল, (৩) চার্বাক দর্শনের বিরুদ্ধে ব্রাহ্মণ্যবাদীদের মগজ ধোলাই। ফলে আমরা দেখতে পেলাম, যে শোষিত সাধারণ মানুষদের উপকারের জন্য চার্বাক দর্শন আত্মাবাদ ও ঈশ্বরবাদকে শানিত যুক্তিতে খণ্ডন করেছিল, সেই শোষিত সাধারণ মানুষই একসময় চার্বাক দর্শনকে এক নীতিহীন দর্শন বলে দূরে ঠেলে দিয়েছিল। এমনকি 'চার্বাক' শব্দটিকে লোকে গালাগাল বলেই ভাবতে শুরু করেছিল।
উপাসনা ধর্মে বিশ্বাসীরা চার্বাকদের আরও নানা নামে চিহ্নিত করেছিল - লোকায়ত, বৃহস্পত্য, স্বাভাবিক, ভূতবাদী ইত্যাদি। চার্বাকরা মনে করতেন, জগৎ স্বভাবগতভাবেই বৈচিত্রময় ও বৈচিত্র্যের কারণ। অতএব ঈশ্বরকে বৈচিত্র্যের স্রষ্টা ভাবাটা ভুল। ভূতবাদী হিসেবে ওঁরা মনে করতেন ক্ষিতি (পৃথিবী), অপ (জল), তেজ (আগুন) ও মরুৎ (বায়ু) - এই চারটি মৌল পদার্থ থেকেই সব কিছুর সৃষ্টি। ধ্বংসে সবই আবার এই চার ভূতেই বিলীন হয়।
চার্বাক দর্শনও সঠিক অর্থে 'দর্শন' নয়, সামগ্রিক জীবনদর্শন হয়ে উঠতে না পারার কারণে।
..........................................................................................
দিগম্বর:
জৈন উপাসনা ধর্মের দু'টি ভাগ। একটি শ্বেতাম্বর, দ্বিতীয়টি দিগম্বর। জৈন মত অনুসারে চব্বিশজন তীর্থংকর জৈন উপাসনা ধর্মের বিকাশ ঘটিয়েছিল। প্রথম তীর্থংকরের নাম ঋষভ বা আদিনাথ। পরবর্তী তীর্থংকররা হলেন অর্জিত, সম্ভব, অভিনন্দ, সুমতি, পদ্মপ্রভ, সুপার্শ্ব, চন্দ্রপ্রভ, সুবিধি, শীতল, শ্রেয়াংশ, বসুপূজ্য, বিমল, অনন্ত, ধর্ম, শান্তি, কুনথ, আর, মল্লি, মুনিসুব্রত, নমি, অরিষ্টনেমি, পার্শ্ব বা পার্শ্বনাথ অথবা পরেশনাথ ও মহাবীর। মহাবীর হলেন চব্বিশতম তীর্থংকর।
এক থেকে বাইশতম তীর্থংকরকে নিয়ে এতো বেশি অতিরঞ্জন ও অলৌকিক ঘটনার ছড়াছড়ি যে, ঐতিহাসিকদের ধারণা এগুলো কল্পকাহিনী। এতে এমনটা মনে হতেই পারে যে, এইসব তীর্থংকরদের অস্তিত্ব ছিল। কিন্তু ভক্তির প্রাবল্যে এঁদের চরিত্রগুলোকে ভক্তরা বেশি রকম বড় করতে গিয়ে অবাস্তব করে তুলেছেন।
তীর্থংকর হিসেবে পার্শ্ব বা পার্শ্বনাথই প্রথম, যাঁর অস্তিত্ব নিয়ে ঐতিহাসিকদের কোনও সন্দেহ নেই। জৈন মত অনুসারে পার্শ্বনাথের জন্ম আনুমানিক ৮১৭ খ্রিস্টপূর্বাব্দে। পিতা অশ্বসেন ছিলেন গোষ্ঠীপতি। এক গোষ্ঠীপতির কন্যার সঙ্গে পার্শ্বনাথের বিয়ে হয়। মানুয়ের জীবনের নানা দুঃখ দেখে তা থেকে পরিত্রাণের উপায় খুঁজতে তিরিশ বছর বয়সে গৃহত্যাগ করেন। এদিক থেকে পার্শ্বনাথের সঙ্গে বুদ্ধের কিছু মিল আমরা পাই। পার্শ্বনাথের দুঃখ চেতনা ছিল জাগতিক, বুদ্ধেরই মতো। সত্যকে জানতে, দুঃখের কারণ জানতে তিরিশ দিন ধরে নিজেকে সমাজ-সংসার থেকে দূরে রেখে গভীর চিন্তায় ডুবিয়ে রাখেন। শেষে দুঃখের কারণ ও তার থেকে অব্যাহতির উপায় খুঁজে পান। সত্তর বছর ধরে তাঁর মতাদর্শ প্রচার করেন। একশো বছর বয়সে মৃত্যু।
পার্শ্বনাথের চার নীতি বা চতুর্যাম:
পার্শ্বনাথ তাঁর প্রচারিত উপাসনা ধর্মে 'চতুর্যাম' অর্থাৎ চারটি নীতি বা ব্রতর কথা বলেছিলেন। (১) অহিংসা - কারও জীবননাশ করবে না। (২) অনৃত - মিথো বলবে না। কারও বিরুদ্ধে মিথ্যে অভিযোগ আনবে না। (৩) অস্তেয় - চুরি করবে না। চোরদের কাছ থেকে কোনও জিনিস কিনবে না। ক্রেতাকে মিথ্যে ওজনে জিনিস বিক্রি করবে না। দ্রব্যে ভেজাল দেবে না। (৪) অপরিগ্রহ - ব্যক্তিগত জমিজমা, ভূসম্পত্তির অধিকারী হবে না।
মহাবীর:
চব্বিশতম তীর্থংকর মহাবীর জৈনদের 'দিগম্বর' সম্প্রদায়ের স্রষ্টা। নগ্নতাবাদী মহাবীরের জন্ম আনুমানিক ৫৯৯ বা ৫৬৯ খ্রিস্টপূর্বাব্দে। জন্ম বৈশালীর বসুকুণ্ড গ্রামে (মজঃফরপুর, বিহার)। পিতা সিদ্ধার্থ ছিলেন একটি উপজাতির গোষ্ঠীপতি। জৈন শ্বেতাম্বরপন্থীদের মতে মহাবীরের বিয়ে হয়েছিল কৌণ্ডিল্য উপজাতির মেয়ে যশোদার সঙ্গে। মহাবীরের একটিই মেয়ে - অনুজা।
দিগম্বর মতে মহাবীর ছিলেন চিরকুমার ও কঠোর ব্রহ্মচারী। তিরিশ বছর বয়সে তাঁর বিপুল সম্পত্তি দান করে দিয়ে গৃহত্যাগ করেন ও পরিব্রাজক বৃত্তি গ্রহণ করেন। তিনি আন্তরিকতার সঙ্গে চেয়েছিলেন দুঃখের কারণ ও দুঃখময় জগৎ থেকে পরিত্রাণের উপায় খুঁজে বের করতে।
পরিব্রাজক জীবনে তিনি কোনও গ্রামে এক রাতের বেশি থাকতেন না। এভাবে তের মাস কেটে যাওয়ার পর কাপড় পরিধান করা ছেড়ে দেন। মহাবীর দিগম্বর থাকার কারণে নানা জায়গায় খারাপ ব্যবহার পেয়েছেন। পরিব্রাজক জীবনের তৃতীয় বছরে তিনি আর এক চিন্তাবিদ গোশাল মংখলিপুত্তের সঙ্গে পরিচিত হন। দু'জনে মত বিনিময় ও চিন্তা বিনিময়ের মধ্যে ছয় বছর কাটিয়ে দেন। তারপর মত পার্থক্যের কারণে দু'জনের বিচ্ছেদ হয়। গোশাল নিজেকে তীর্থংকর ঘোষণা করেন এবং তীর্থংকর মহাবীরকে ত্যাগ করেন।
দীর্ঘ বারো বছরের পরিব্রাজক জীবনে তিনি নগ্ন হয়ে শীত-গ্রীষ্মের তাপের কষ্ট পেয়েছেন। নগ্নতার কারণে ভিক্ষেও জোটেনি। দীর্ঘদিন কেটেছে অনশনে, মানুষের ও কুকুরের তাড়া খেয়ে। শরীরকে এমনভাবে কষ্ট দেওয়ার কারণ, মহাবীর এইসময় মনে করতেন দুঃখভোগই পাপস্খালন এবং মুক্তির উপায়।
ঋজুপালিকা নদীর তীরে জ্রিম্বিকা গ্রামে একটা শালগাছের নীচে বসে গভীর চিন্তায় নিমগ্ন থাকাকালীন তিনি বিভিন্ন বিষয় নিয়ে উপলব্ধিতে পৌঁছোন বা জ্ঞান লাভ করেন। এরপর উপাসনা ধর্ম প্রচারে বের হন। মহাবীরের মামা বৃজি উপজাতির গোষ্ঠী প্রধান চেটক ছিলেন মহাবীরের পৃষ্ঠপোষক। মগধরাজ অজাতশত্রু থেকে কৌশাম্বীর রাজা স্থানক মহাবীরকে সম্মান ও সমাদরের সঙ্গে স্বাগত জানান। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি বিহার, উত্তরপ্রদেশ ও মধ্যপ্রদেশে উপদেশ প্রচার করে বেরিয়েছেন। ৮৪ বছর বয়সে, অন্য মতে ৭২ বছর বয়সে তিনি পাবা'য় (বর্তমান গোরক্ষপুর) শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
মহাবীর ছিলেন বুদ্ধের সমসাময়িক। ছিলেন অত্যন্ত ভালো সংগঠক। জৈন সংঘকে সুদৃঢ় ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
মহাবীর বৈদিক যুগের সমসাময়িক ছিলেন। বেদকে অভ্রান্ত মনে করতেন না। তিনি ছিলেন নিরীশ্বরবাদী নাস্তিক, অলৌকিকে অবিশ্বাসী, নিয়তিবাদে অবিশ্বাসী। আপেক্ষিক গুণবাদ বা 'স্যাদবাদ'-এ বিশ্বাসী ছিলেন।
মহাবীর চতুর্যামের পরিবর্তে 'পঞ্চব্রত' বা পাঁচটি নীতির কথা বলেছিলেন। পার্শ্বনাথের নীতিগুলো সরিয়ে তিনি নতুন কিছু নীতির প্রবর্তন করেননি। চতুর্যামের চারটি নীতির সঙ্গে একটি নতুন নীতি যুক্ত করেছিলেন। নীতিটি হলো ব্রহ্মচর্য। 'ব্রহ্মচর্য' বলতে শুধু সহবাস থেকে বিরত থাকা বোঝায় না, সমস্ত ইন্দ্রিয়ভোগ থেকে বিরত থাকা বোঝায়।
এই পঞ্চব্রতকে আবার মহাবীর দু'ভাগে ভাগ করেছিলেন। (১) অনুব্রত, (২) মহাব্রত। গৃহী জৈনদের জন্য নরম করে তৈরি হয়েছিল 'অনুব্রত'। গৃহীদের পক্ষে 'অহিংসা' বলতে বলা হয়েছে - উদ্ভিদ জাতীয় প্রাণীর ঊর্ধ্বতন যেসব প্রাণী, তাদের প্রতি অহিংসা ব্রত পালন করতে হবে। 'ব্রহ্মচর্য' বলতে বলেছেন, গৃহীদের একপত্নী ব্রত পালনের কথা।
শ্রমণদের বেলায় 'ব্রহ্মাচর্য' আবশ্যিক শর্ত। দিগম্বরপন্থীরা মনে করেন শ্রমণ বা জৈন সন্ন্যাসীদের অবশ্যই সমস্ত পার্থিব বন্ধন থেকে মুক্ত থাকতে হবে, নগ্ন থাকতে হবে। দিগম্বরপন্থীরা আরও মনে করেন, তীর্থংকররা প্রত্যেকেই পার্থিব বন্ধন থেকে মুক্ত হয়েই জ্ঞানের সাধনা করেছিলেন। জ্ঞান লাভ করেছিলেন। সুতরাং তীর্থংকরদের ছবি আঁকতে হলে নগ্নই আঁকতে হবে, মূর্তি খোদিত করতে হলে তা হবে নগ্ন। কাপড় পরিয়ে সভ্য সাজাবার প্রয়াস মিথ্যাকে সত্যি বলে প্রচার ছাড়া কিছু নয়। এই ধরনের মিথ্যাচারিতা 'অনৃত' বা সত্য নীতিকে লঙ্ঘন করা।
জৈন দার্শনিকদের মধ্যে পরমাণু সম্পর্কে ধারণা ছিল। উদ্ভিদবিদ্যা, জীববিদ্যা, চিকিৎসা বিজ্ঞান ও জ্যোতির্বিদ্যার উন্নতির ক্ষেত্রে জৈন দার্শনিকদের অবদান অনস্বীকার্য।
জৈন ধর্মের প্রধান সংগঠক ছিলেন দিগম্বরবাদী মহাবীর। তাই বৈদিক যুগের পুরোহিত সম্প্রদায়ের তীব্র ক্ষোভ দিগম্বরদের উপর ছিল। ঈশ্বর নেই; মানে ঈশ্বর উপাসনা, যাগ-যজ্ঞ, হোম, বলি, পুরোহিতদের প্রণামী দেওয়া সবই অর্থহীন। এতো দস্তুরমতো বৈদিক পুরোহিতদের অস্তিত্বের সংকট। এই সংকট কাটাতে পুরোহিতরা নিরীশ্বরবাদীদের উপর খড়গহস্ত ছিলেন। এমনকি নিরীশ্বরবাদীদের ঝাড়ে-বংশে নির্মূল করতে আক্ষরিক অর্থেই অস্ত্র তুলে নিয়েছিলেন হাতে।
দিগম্বর ও শ্বেতাম্বর-এর বিরোধ:
জৈন উপাসনা ধর্ম প্রধানত নীতি ধর্ম। জৈন ধর্ম মহাবীরের সময় দু'টি শাখায় ভাগ হয়ে যায়। (১) দিগম্বর, (২) শ্বেতাম্বর। দিগম্বররা শরীরে কোনও কাপড় রাখেন না। তাঁরা নগ্নতাবাদী ও প্রকৃতিবাদী। শ্বেতাম্বররা সাদা কাপড় পরেন। শ্বেতাম্বররা মনে করেন জৈন ধর্মের বারোটি প্রাচীন 'অঙ্গ' গ্রন্থ আছে। এই বারোটি 'অঙ্গ' নামের ধর্মগ্রন্থ ছাড়াও 'উপাঙ্গ' নামে আরও বারোটি ধর্মগ্রন্থ আছে। অঙ্গ ও উপাঙ্গ ছাড়াও আরও কিছু গ্রন্থকে শ্বেতাম্বররা জৈন ধর্মের অন্তর্গত বলে মনে করেন।
দিগম্বরপন্থীরা মহাবীরের সময়ের আগে লেখা কোনও জৈন গ্রন্থকেই প্রামাণ্য বলে স্বীকার করে না। দিগম্বরপন্থীদের কিছু ধর্মীয়গ্রন্থ আছে, যেগুলো চারটি শ্রেণীতে বিভক্ত। সেসব গ্রন্থ মহাবীরের সময়ে ও পরবর্তীকালে লেখা।
পার্শ্বনাথের চতুর্যাম শ্বেতাম্বররা শ্রদ্ধার সঙ্গে স্বীকার করেন। দিগম্বররা মানেন মহাবীরের পঞ্চব্রত। দিগম্বররা কিছুটা কট্টরপন্থী। তাঁরা মনে করেন, (১) নারীরা মোক্ষ লাভের অধিকারী নয়। (২) চিত্রে বা মূর্তিতে তীর্থঙ্করদের নগ্ন রাখতে হবে, চোখ থাকবে মুদ্রিত। (৩) জৈন শ্রমণ অর্থাৎ জৈন সাধুদের নগ্ন থাকতে হবে। (৪) প্রকৃত জ্ঞানীদের কোনও খাদ্য গ্রহণের প্রয়োজন হয় না, যেমন হয়নি মহাবীরের। (৫) মহাবীরই শেষ প্রকৃত জ্ঞানী বা তীর্থঙ্কর। (৬) সব শাস্ত্র ও ধর্মীয় গ্রন্থই মানুষের লেখা, তাই চিরন্তন বা শাশ্বত নয়। এই শেষ বক্তব্যের মধ্যে বেদকে অস্বীকার করা হয়েছে স্পষ্টভাবে।
জৈনদের এই দু'টি ভাগ আবার পরবর্তীকালে আরও কিছু উপ সম্প্রদায়ে বিভক্ত হয়। শ্বেতাম্বররা তিনটি উপ সম্প্রদায়ে বিভক্ত - মূর্তিপূজক, তেরপন্থী ও স্থানকবাসী।
উত্তর ভারতে শ্বেতাম্বরদের প্রাধান্য রয়েছে। দিগম্বররা পাঁচটি উপ সম্প্রদায়ে বিভক্ত। এরা হলো - বীসপন্থী, তেরপন্থী, তোতাপন্থী, তারণপন্থী এবং গুনামপন্থী। দক্ষিণ ভারতে এদেরই প্রাধান্য। ভারতে সামগ্রিকভাবে শ্বেতাম্বরপন্থীদের-ই স্পষ্ট প্রাধান্য রয়েছে।
স্যাদবাদ বা আপেক্ষিক গুণবাদ:
জৈনরাই প্রথম 'আপেক্ষিক গুণবাদ' বা স্যাদবাদের কথা বললো। এই মতবাদের মূল কথা - কেউ যখন কোনও বস্তুর বর্ণনা দেয়, তখন সে তার ইন্দ্রিয়লব্ধ জ্ঞান থেকে দেয়। বস্তুর এই বর্ণনা তখনকার মতো সত্য হলেও নিত্য সত্য নয়। স্যাদবাদে ছয় অন্ধের হাতি দেখার কাহিনী বলা হয়েছে। একই হাতি কারও কাছে দড়ির মতো, কারও কাছে গুঁড়ির মতো, কারও কাছে বা সাপের মতো। এসবই আংশিক সত্য, সম্পূর্ণ সত্য নয়।
ভোরের সূর্য ও গোধূলির সূর্য লাল টুকটুকে। দুপুরের সূর্য যখন মধ্য আকাশে, তখন সে আগুনের গোলা। এসবই সত্যি। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সত্যিটা পাল্টে যায়, যাকে বলে 'আপেক্ষিক গুণ'। আপেক্ষিক গুণ সংক্রান্ত মতবাদই 'স্যাদবাদ'। যুক্তিবাদের একটি সিদ্ধান্তের প্রকাশ আমরা দেখতে পাই স্যাদবাদে।
মোক্ষ:
জৈন মাত্রেই নিরীশ্বরবাদী। জৈন ধর্মগ্রন্থের লেখকরা ঈশ্বর ধারণাকে খণ্ডন করেছিলেন। জৈনরা সর্বশক্তিমান ঈশ্বরে বিশ্বাস করে না বটে, কিন্তু দেবতায় বিশ্বাস করে। জৈন ধর্মে দেবতা ও ঈশ্বরের সংজ্ঞায় যথেষ্ট পার্থক্য রয়েছে। জৈনরা গুণের প্রতীককে 'দেবতা' বলে। দেবতার কোনও অলৌকিক ক্ষমতা নেই। পার্থিব কোনও কিছু দেবার ক্ষমতা নেই। মানুষ সাধনার দ্বারা গুণ অর্জনের মধ্য দিয়ে দেবতা হতে পারে।
বৌদ্ধদের একাধিক সম্প্রদায় মনে করে, যে কেউ সাধনার দ্বারা বৌদ্ধত্ব লাভ করতে পারে, বুদ্ধ হতে পারে। জৈনদের 'দেবতা' ধারণা অনেকটা এইরকম। তারা মনে করে, সাধনা ও জ্ঞানার্জনের ফল হিসেবে পরজন্মে দেবতা হওয়া যায়। এই দেবতারা জন্ম-মৃত্যুর অধীন। দেবতা জন্মে খারাপ কাজ করলে পরজন্মে কীট হয়ে জন্মাতে পারে। অর্থাৎ জৈনরা জন্মান্তরবাদে বিশ্বাসী।
দেবতা হওয়ার উপায় কর্মবন্ধন থেকে মুক্তি। মুক্তির জন্য জরুরি (১) সম্যক জান, (২) সম্যক দর্শন, (৩) সম্যক চরিত্র। দেবত্ব লাভ বা মোক্ষ লাভের এই তিন আবশিক শর্তকে বলে 'রত্নত্রয়'।
'সম্যক জ্ঞান' বলতে জৈন ধর্ম বিষয়ে বিস্তৃত জ্ঞান ও স্বচ্ছ বা স্পষ্ট জানকে নির্দেশ করা হয়েছে। 'সম্যক দর্শন' অর্থে জৈন ধর্মের নীতিতে অবিচল থাকার কথা বলা হয়েছে। 'সম্যক চরিত্র' বলতে জৈন ধর্মের নীতি জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রয়োগের কথা বলা হয়েছে।
জৈন সংঘ:
জৈন সংঘ ও বৌদ্ধ সংঘের আদর্শ মোটামুটি একই। আদিম উপজাতি সম্প্রদায়ের মতো জৈন সংঘেও ব্যক্তিগত সম্পত্তি বলে কিছু ছিল না। শ্রমণদের সমস্ত রকমের জাগতিক ইন্দ্রিয় সুখকে বর্জন করত হতো। আহার ও শয্যা বিষয়ে কোনও মতামত প্রকাশ ধর্মচ্যুতি হিসেবে গণ্য হতো।
জৈন ধর্মের বিকাশ ভারতের বাইরে কোথাও হয়নি। ভারতের গুজরাট, মহারাষ্ট্র, রাজস্থান, উত্তরপ্রদেশ ও মধ্যপ্রদেশে জৈন ধর্মের মানুষরা সংখ্যায় যথেষ্ট। ১৯৬০-এর জনগণনা অনুসারে ১৬ লক্ষ ৫০ হাজার জৈন ধর্মের মানুষ বসবাস করতো।
অণু-পরমাণু বা 'পুদ্গল'
জৈন দাশনিকদের মধ্যে পরমাণু সম্পর্কে ধারণা ছিল। জৈন দার্শনিকরা বললেন, স্থূল জড়বস্তুকে ভাঙা যায়। ভাঙতে ভাঙতে এমন একটা ক্ষুদ্রতম অংশে পৌঁছায়, যখন আর ভাঙা সম্ভব নয়। জড়ের বা 'পুদ্গল'-এর এই অবিভাজ্য সূক্ষ্ম কণাকে 'অণু' বলে। অণুই জড় জগতের মৌলিক উপাদান।
জৈন পরমাণুবাদের সঙ্গে ন্যায়বৈশেষিকদের পরমাণুবাদের গুণগত পার্থক্য আছে। ন্যায়বৈশেষিক মতে, পরমাণুদের মধ্যে আবার গুণগত পার্থক্য আছে। জৈন মতে, পরমাণুদের মধ্যে গুণগত কোনও পার্থক্য নেই। প্রতিটি পরমাণু সমগুণসম্পন্ন। উদ্ভিদবিদ্যা, জীববিদ্যা, চিকিৎসা বিজ্ঞান ও জ্যোতির্বিদ্যার উন্নতির ক্ষেত্রে জৈন দার্শনিকদের অবদান অনস্বীকার্য।
জৈন ও বণিক সম্প্রদায়:
জৈন ধর্ম মূলত নীতিমূলক ধর্ম। এই উপাসনা ধর্মে অহিংসাকে বেশি রকম গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। অজ্ঞাতসারে একটি পোকাকে হত্যা করলেও তা পাপ। জৈনদের অনেকেই এক টুকরা সাদা কাপড় দিয়ে নাক-মুখ ঢেকে রাখে, যাতে কোনও ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র প্রাণী নাকে-মুখে ঢুকে গিয়ে মারা না যায়।
ভারতের বাইরে জৈন ধর্ম পা রাখতে না পারলেও ভারতের ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের মধ্যে জৈন উপাসনা ধর্ম দ্রুত প্রসার লাভ করেছিল। এর পিছনেও কার্যকারণ সম্পর্ক ছিল। জৈন ধর্ম অহিংসার উপর এতো বেশি জোর দিয়েছিল যে, কৃষিজীবীদের পক্ষে এই ধর্ম গ্রহণ করা সম্ভব ছিল না। কারণ চাষের সময় গাছে পোকা লাগলে তা না মেরে হাত গুটিয়ে বসে থাকলে নিজেদের মরতে হয়। গাছে পোকা লাগা ও পোকাদের মেরে ফসল বাঁচানো কৃষিরই অঙ্গ।
ব্যক্তিগত সম্পত্তি-জমিজমা কেনা জৈন ধর্মে নিষিদ্ধ। জমিজমা কিনে শ্রমজীবীদের দিয়ে চাষবাস করে আয়ের পথও ছিল বন্ধ। ফলে জৈন উপাসনা ধর্মে দীক্ষিতরা ব্যবসার দিকে আকর্ষিত হয়েছিল এবং এ ব্যাপারে যথেষ্ট দক্ষতা অর্জন করেছিল। গুজরাট, মহারাষ্ট্রের উপকূলে নৌ-বাণিজ্যের সুবিধে ছিল। জৈন ব্যবসায়ীদের কেউ কেউ পণ্যদ্রব্য নিয়ে জাহাজ ভাসিয়ে দিলেন। ব্যবসা যে ভালোই চলছিল, সে খবর জানতে পারি বিভিন্ন শিলালিপি থেকে। এইসব শিলালিপিতে ব্যবসায়ীদের নানা দান-ধ্যানের খবর থাকতো।
সংঘগুলো ব্যাঙ্কের কাজও করতো। বণিকরা সংঘের মারফত সুদে টাকা ধার দিতো। মহারাষ্ট্রের নাসিকে পাওয়া একটি শিলালিপি থেকে জানা যায়, সুদের টাকায় একটি সংঘের কাজ পরিচালিত হতো। বিজ্ঞানের উন্নতির পাশাপাশি ব্যবসার উন্নতির ক্ষেত্রেও জৈনদের অবদান স্বীকার করতেই হয়। জৈন ধর্ম গ্রন্থগুলো থেকে আমরা জানতে পারি যে, আদিতে জৈনরা বাস করতেন প্রধানত কোসল, বিদেহ, মগধ ও অঙ্গ অঞ্চলে। তারপর আমরা জানতে পাচ্ছি কলিঙ্গ দেশে জৈনদের ছড়িয়ে পড়ার কথা। সেখানকার রাজা খারবেল জৈনধর্মে বিশ্বাসী ছিলেন। তাঁর আমলে খণ্ডগিরি ও কুমারী পর্বতে কয়েকটি জৈন গুহা তৈরি হয়েছিল। পাবা'য় গড়ে উঠেছিল একটি মঠ।
জৈন ধর্ম তারপর ছড়িয়ে পড়ে মথুরায়। এই সময়টা হলো প্রথম ও দ্বিতীয় শতক। এরপর জৈনদের প্রভাব ছড়ায় মালব ও উজ্জয়িনীতে। গুপ্ত যুগের বিভিন্ন পুরাতত্ত্ব নিদর্শন থেকে জানা যায় সেসময় জৈন ধর্মের প্রভাব ছিল।
পাহারপুর, তক্ষশীলা ও গুজরাটে জৈন ধর্ম প্রভাব বিস্তার করে। সপ্তম থেকে দশম শতকে জৈন ধর্মে দেখা দেয় ভাটার টান। শেষ পর্যন্ত জৈন ধর্ম টিকে রইলো কিছু ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের মধ্যে; যাদের সিংহভাগই গুজরাট, মহারাষ্ট্র, রাজস্থান, উত্তরপ্রদেশ ও মধ্যপ্রদেশবাসী।
- অলৌকিক নয়, লৌকিক (৫ম)

Comments