চাড্ডিগণ [দুই]
বিশ্ব হিন্দু পরিষদের পক্ষে অনিল ভট্টাচার্য নস্ত্রাদামুসের মতো বাটপারের ভবিষ্যদ্বাণীর কথা শুনিয়ে উগ্র হিন্দু জাতীয়তাবাদকে জাগরিত করতে সচেষ্ট হয়েছিলেন। শুনিয়েছিলেন হিন্দুদের বিশ্ব বিজয় ও মুসলমানদের ধ্বংসের দিন দ্রুত এগিয়ে আসার কথা। অনিল ভট্টাচার্যের যুক্তি ছিল-
"অতীতের প্রতিটি ভবিষ্যদ্বাণী যেহেতু মিলেছে, সুতরাং অবশ্যই আমরা ধরে নিতে পারি, ভবিষ্যতে হিন্দুদের বিশ্ব বিজয়ের যে কথা নস্ট্রাডামুস বলেছেন তা-ও অবশ্যই মিলবে।"
........................................................................................
বাটপার নস্ত্রাদামুসের ১ নাম্বার সেঞ্চুরীর (মোট ১০টা সেঞ্চুরী আছে, ৭ নাম্বার সেঞ্চুরী [৪২টা] বাদে বাকিগুলোতে ১০০ টা করে তথাকথিত 'ভবিষ্যদ্বাণী' আছে বলে এগুলোকে 'সেঞ্চুরী' বলে) ৫০ নাম্বার কবিতা-
De l'aquatique triplicite naistra.
D'un qui fera le jeudi pour sa feste:
Son tadt, loz, regne, sa puissance coistra,
Par terre & mer aux Oriens tempeste.
অর্থ:
"তিনটে পানির সঙ্কেত থেকে জন্মাবে এক মানুষ, যে বৃহস্পতিবারকে তার ছুটির দিন হিসেবে পালন করবে।
তার বিক্রম ছড়িয়ে পড়বে চারদিকে, আর পশ্চিমে সে নানা ঝামেলা ডেকে আনবে।"
এরিকা চিটহ্যাম এর মতে এই কবিতায় নস্ত্রাদামুস আয়াতুল্লাহ খোমেনির আবির্ভাব ও ছড়িয়ে পড়া বিক্রমের কথা বলেছেন। তার মতে, 'তিনটি পানির সঙ্কেত' মানে - মীন, কর্কট আর বৃশ্চিক। আয়াতুল্লার কুষ্ঠিতে নাকি ভিন্ন ভিন্ন পরিপ্রেক্ষিতে এই 'তিনটি পানির সঙ্কেত' এর উল্লেখ আছে! সুতরাং এই কবিতা খোমেনির সম্বন্ধেই, যিনি পশ্চিমে ঝামেলা ডেকে এনেছিলেন।
অন্যদিকে হিরন্নাপ্পা'র বই 'হিন্দু ডেস্টিনি ইন নস্ত্রাদামুস' এ এই কবিতার একটা আজগুবি ব্যাখ্যা আছে। সেটি ছাপা হয়েছিল পশ্চিমবঙ্গের 'আলোকপাত' পত্রিকায়। 'আলোকপাত' থেকে আবার হুবহু কবিতার অনুবাদ এবং ব্যাখ্যা মেরে দিয়েছিলেন সুধীর বেরা তার বই 'নস্ট্রাডামের ভবিষ্যদ্বাণী ও ভারতের ভবিষ্যৎ' এ। হিরন্নাপ্পা'র মতে এই কবিতাতে কোনও এক হিন্দু ধর্মনেতা সম্বন্ধে ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছে। তার মতে 'তিনটি পানির সঙ্কেত' হচ্ছে আরব সাগর, বঙ্গোপসাগর আর ভারত মহাসাগর। সেখান থেকে জন্ম নেয়া মানে ভারতবর্ষে জন্মানো। হিন্দুরা বৃহস্পতিবারকে পবিত্র দিন হিসেবে পালন করে। কাজেই কবিতাতে কোনো হিন্দু মহর্ষির আগমন বার্তা দেয়া আছে!
......................................................................................
"আর্যদের আক্রমণে পরাজিত হওয়ার পর প্রাক আর্য যুগের অনেকেই বশ্যতা স্বীকার করে মেনে নিলেন 'দাস' জীবন। এদেরকে আর্য সমাজের অন্তর্ভুক্ত করা হলো। পাশাপাশি 'মনুর বিধান'-কে চূড়ান্ত বলে ধরে নিয়ে আর্যরা এঁদের চিহ্নিত করলেন 'শূদ্র' বলে। সেই সঙ্গে কেড়ে নিলেন এঁদের শিক্ষা-দীক্ষা সহ মানুষের প্রতিটি জন্মগত অধিকার। সে এক ভয়ংকর অমানবিক ও বর্বরোচিত অত্যাচারের ইতিহাস। যাঁরা আর্যদের বশ্যতা স্বীকার না করে পালিয়ে গেলেন ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চলের বনে-জঙ্গলে, তাঁরা একসময় সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনের মূলস্রোত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়লেন। শিক্ষা-দীক্ষায় পিছিয়ে পড়লেন। পিছিয়ে পড়লেন অর্থনৈতিকভাবেও। আর্যরা এঁদেরও চিহ্নিত করলেন 'দস্যু' বলে। ভারতবর্ষের দক্ষিণাঞ্চলে সুসভ্য প্রাক আর্য সভ্যতা ছিল। দক্ষিণ ভারতে আর্য অভিযানে প্রাক আর্য সভ্যতা তীব্র আঘাত পেয়েছিল। তারপর এই বলয়ে প্রাক আর্য সভ্যতা ও আর্য সভ্যতার মিশ্রণে একটি নতুন সভ্যতা রূপ পেয়েছিল। প্রত্ন-ঐতিহাসিকরা মনে করেন আর্যদের দক্ষিণ ভারত অভিযান এবং প্রাক আর্য সভ্যতার সঙ্গে তাদের যুদ্ধই অতিরঞ্জিত হয়ে রামায়ণ কাহিনি হয়ে উঠেছে। উত্তর ভারতে আর্যদের মধ্যেকার যুদ্ধ অতিরঞ্জিত হয়ে মহাভারত হয়ে উঠেছে। আর্যদের তৈরি জঘন্য ও ঘৃণ্য 'বর্ণাশ্রম' প্রথা ছিল মানুষে মানুষে বিভেদ তৈরির এক প্রক্রিয়া। পৃথিবীর কোনও ধর্মের ইতিহাসে এমন নোংরা জাতপাত তৈরির কোনও দৃষ্টান্ত নেই। আর্যরা ঘোড়া ও লোহার অস্ত্র বানাবার বিদ্যার জোরে তিন-চতুর্থাংশ মানুষকে সমস্ত অধিকার থেকে বঞ্চিত করে পশুরও অধম এক জীবন যাপনে বাধ্য করলেন। তাদের শিক্ষালাভ নিষিদ্ধ হলো। কানে বেদ মন্ত্র ঢুকলে সেই কানে গরম সিসা ঢালার নির্দেশ দিলেন আর্য ধর্মীয় বিধানের রচয়িতা মনু। কেউ অস্ত্র শিক্ষা করলে তার আঙুল কাটা হলো। তপস্যা করলে শিরচ্ছেদ হয়েছে। এই শূদ্রদের কাছে বেঁচে থাকার নতুন আশ্বাস নিয়ে, গণতন্ত্রের নতুন হাওয়া নিয়ে এসেছিল বৌদ্ধ ধর্ম। বেদ, ব্রাহ্মণ্য প্রথা, বর্ণাশ্রম প্রথা ও যাগযজ্ঞ বিরোধী, ঈশ্বরহীন এই সাম্যবাদী দর্শনের প্রতি শূদ্ররা আকৃষ্ট হয়েছিল। শিব শক্তির উপাসক হিন্দু শূদ্ররা বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করে ভারতের ধর্মীয় ইতিহাসে নতুন মাত্রা যুক্ত করলো। খ্রিস্টপূর্ব ৩য় শতক থেকে খ্রিস্টীয় ৮ম শতক, এই প্রায় এগারো'শ বছর সম্রাট অশোক থেকে হর্ষবর্ধনের রাজত্বকাল পর্যন্ত বৌদ্ধ ধর্ম ভারতবর্ষে জোরদারভাবে কায়েম হয়েছিল। রাজা, সেনাপতি, শ্রেষ্ঠী, পুরোহিতরা দলে দলে রাজধর্ম হিসেবে বৌদ্ধ ধর্ম নিতে লাগলেন। ফলে একদিকে হিন্দু অবতারবাদ, পুনর্জন্মবাদ, অদৃষ্টবাদ ঢুকে পড়লো বৌদ্ধ ধর্মে; অন্যদিকে বৌদ্ধ ধর্মে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ও বণিক শ্রেণির প্রাধান্যের ফলে সাম্যবাদী ও গণতান্ত্রিক এই দর্শন চ্যুত হলো। হর্ষবর্ধনের মৃত্যুর পর বৌদ্ধ ধর্ম রাজশক্তির পৃষ্ঠপোষকতা হারালো। একই সঙ্গে বৌদ্ধ ধর্ম আক্রান্ত হলো কুমারিল ভট্ট ও শংকরের মতো হিন্দু মৌলবাদীদের হাতে। বহু বৌদ্ধ হত্যার মধ্য দিয়ে হিন্দুত্ববাদীরা শান্ত হলো না। বরং তারপরও জাঁকিয়ে বসলো বৌদ্ধদের উপর হিন্দুত্ববাদীদের অত্যাচার। শুরু হলো বৌদ্ধদের দলে দলে হিন্দু ধর্মে ফিরে আসা। বৌদ্ধ শ্রমণ বা ভিক্ষুরাই হিন্দু ধর্মে ফিরে হিন্দু ধর্মকে দিলেন অবধূত, সিদ্ধাই, হঠযোগী, সহজিয়া প্রভৃতি নতুন নতুন ধর্মীয় সম্প্রদায়। এই ধর্মীয় সম্প্রদায়গুলো বেদ ও উপনিষদকে অগ্রাহ্য করে প্রাক আর্য যুগের লিঙ্গ-যোনির পূজাকে, তন্ত্রকে গ্রহণ করলো। হিন্দুরা বুদ্ধকে হিন্দু দশ অবতারের এক অবতার হিসেবে স্বীকৃতি দিলো। বৌদ্ধ ধর্মকে হিন্দু ধর্মেরই শাখা বলে চালাতে সচেষ্ট হলো।
পৃথিবীর প্রথম যুক্তিবাদী, প্রথম সাম্যবাদী চিন্তানায়ক বুদ্ধ এক সাম্য ও গণতন্ত্রের দর্শন প্রচার করেছিলেন। তাঁর ধর্মের ভিত্তি ছিল সাম্য, গণতন্ত্র, ঈশ্বরের অস্তিত্ব অস্বীকার, আত্মার অবিনশ্বরতাকে অস্বীকার, বেদের অভ্রান্ততাকে অস্বীকার। তাঁর ধর্মে উপাসনা নেই, মোক্ষ নেই। আছে সদাচার। চরক, সুশ্রুত, নাগার্জুন, ভাস্করাচার্য, বাৎস্যায়ন, কৌটিল্য, পাণিনি প্রমুখ মননশীল পণ্ডিতরা ছিলেন বৌদ্ধ বা বৌদ্ধ ভাবাশ্রয়ী। বুদ্ধের মৃত্যুর পর বৌদ্ধ ধর্ম বিভিন্ন 'যান' বা পন্থায় ভাগ হয়ে যায় আর্য বা হিন্দুধর্মের চাপে। বৌদ্ধ ধর্মের প্রধান দুটি ভাগ হলো 'হীনযান' ও 'মহাযান'। যাঁরা বুদ্ধের দর্শন, আদর্শ ও পঞ্চশীলে বিশ্বাস নিয়ে রইলেন, তাঁরা চিহ্নিত হলেন 'হীনযান' হিসেবে। যাঁরা আর্য হিন্দুদের আচার, সংস্কার, কুসংস্কারের সঙ্গে বৌদ্ধ ধর্মকে মিশিয়ে জগাখিচুড়ি এক ধর্মকে বৌদ্ধ ধর্ম বলে প্রচার করলেন, তাঁরা পরিচিত হলেন 'মহাযানী' হিসেবে। মহাযানপন্থীরা বৌদ্ধ ধর্মের নামে লিঙ্গ-যোনির আরাধনা, তন্ত্রের আরাধনা শুরু করলেন। তাঁদের আরাধ্য হিসেবে শিব, নীলসরস্বতী, অপরাজিতা, মারীচি, প্রজ্ঞাপারমিতা, তারা, নীলতারা, বজ্রতারা, পীঠতারা, ভৈরবী, ষোড়শী, মহাকালী ইত্যাদি দেবদেবী ঢুকে পড়লো। মহাযানের থেকেই পরবর্তীতে আরও কয়েকটি 'যান' তৈরি হলো; যেমন মন্ত্রযান, কালচক্রযান, বজ্রযান, সহজযান ইত্যাদি। বঙ্গদেশে সহজিয়ারা এই সহজযান থেকেই এসেছেন।"
- 'প্রবাদ-সংস্কার-কুসংস্কার (১ম)', প্রবীর ঘোষ
বাঁশ🤣🤣🤣
.....................................................................................
পশুর মতো করে মিলিত হওয়া এবং স্ত্রী পশুকে মৈথুন করার উল্লেখ বৈদিক সাহিত্যে আছে। আছে মনুসংহিতাতেও। এই বিষয়ে 'অলৌকিক নয়, লৌকিক' সিরিজের পঞ্চম বইয়ে অনেকগুলো রেফারেন্স দেয়া আছে। তাই পশুকামিতার মতো যৌন বিকৃতি যে কেবল মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে দেখা যায়, এই ধারণাটি খণ্ডিত তথ্য। বহিরাগত আরবদের মতো বহিরাগত আর্যরাও এই বিকৃতির চর্চা করতো, যা উপমহাদেশে এখনো চলমান। ইংরেজিতে এই বিকৃতিকে 'Zoophilia' বলে।
......................................................................................
"হিন্দু উপাসনা ধর্মে টোটেমের প্রভাব:
টোটেম গোষ্ঠীর মানুষরা কিছু বিধি-নিষেধ মেনে চলে। এই বিধি-নিষেধকে বলে 'টাবু'। বিয়ের ব্যাপারে প্রত্যেকেই প্রায় 'টাবু' বা নিয়ম-কানুন মেনে চলে। এক টোটেম গোষ্ঠীর পুরুষ বা নারী সেই টোটেম গোষ্ঠীর নারী বা পুরুষকে বিয়ে করে না।
হিন্দুদের গোত্র ব্যবস্থা টোটেম প্রথা থেকেই এসেছে। গোত্রের নাম দেখলেই হিন্দু ধর্মীয় চেতনায় টোটেমের প্রভাবের পরিচয় পাওয়া যায়। শাণ্ডিল্য মনে ষাঁড়, গৌতম অর্থে গরু, ভরদ্বাজ মানে ভরত পাখি, মৌদগল্য হলো মাগুর মাছ, কাশ্যপ মানে কচ্ছপ। কোনও গোত্রের মানুষ তার টোটেম খাবে না, তার গোত্রের কাউকে বিয়ে করবে না, এটাই ছিল 'টাবু'।
হিন্দু উপাসনা ধর্মে আমরা অবতার হিসেবে মীন, কূর্ম, বরাহ ইত্যাদি প্রাণীর উল্লেখ পাই। শ্রীকৃষ্ণ ছিলেন শুনক গোত্রধারী, যার টোটেম হলো কুকুর।
হিন্দুদের কিছু ধর্মশাস্ত্রের নামও পশুদের নামে। যেমন: শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ। শ্বেতাশ্বতর অর্থাৎ সাদা অশ্বতর। ঘোড়া ও গাধার মিলনজাত সাদা রঙের পশু। তৈত্তিরীয় উপনিষদে তৈত্তিরীয় শব্দটি এসেছে তিত্তির পাখি থেকে। এমন উদাহরণ প্রচুর রয়েছে।
আদিবাসীদের মধ্যে হাঁসদার টোটেম হলো হাঁস, হেমব্রেম-সুপারি, সরেন-আমলকি গাছ, মারাণ্ডি-ঘাস, মাণ্ডি-পিয়াল গাছ। লোধাদের গোত্র শুশুক।
ডবলিউ রবার্টসন স্মিথ তাঁর 'রিলিজিয়ন অফ দি সেমিটিজ' (Religion Of The Semites by W. Robertion Smith) গ্রন্থে লিখেছেন, বলিদান প্রথার মূলে রয়েছে টোটেম প্রথা। বিশেষ অনুষ্ঠান বা উৎসবে টোটেম প্রাণীকে হত্যা করে তাকে খাবার হিসেবে গ্রহণ করা হয়।
আদিম সংস্কৃতির কিছু কিছু অবশেষ এখনও টিকে রয়েছে সংস্কৃতিগতভাবে পিছিয়ে থাকা অঞ্চলগুলোতে। সেখানে এখনও নিষ্ঠুর বলিপ্রথা টিকে রয়েছে। টিকে রয়েছে 'প্রগতিশীল' পশ্চিমবঙ্গেও। বিহার ও ঝাড়খন্ডে বলির বিরুদ্ধে আইনের প্রয়োগ করার আদেশ দেওয়া হয়েছে - যে দু'টি প্রদেশকে 'পিছিয়ে পড়া' বলে আমরা বাঙালিরা নাক সিঁটকোই।"
- অলৌকিক নয়, লৌকিক (৫ম)
.......................................................................................
"ভারতের তথাকথিত কিছু অতি বিশিষ্ট দার্শনিক ও ঐতিহাসিক জেনে বুঝেই বুদ্ধকে নিজের মনমতো ছাঁচে ঢালতে চাইছেন। জেনে বুঝে সত্যকে বিকৃত করার খেলায় মেতেছেন। উচ্চ বর্ণের হিন্দু দার্শনিক ও ঐতিহাসিকদের অনেকেই বুদ্ধকে আরও বড় করে দেখাতে গিয়ে দাস মালিকদের পক্ষে বুদ্ধের সরবতা বিষয়ে চোখ-কান বুজে থেকেছেন। বুদ্ধের সময়কার সমাজে ব্যাপক ক্রীতদাস প্রথা ছিল, ভয়ংকর দারিদ্র্য ছিল। অত্যন্ত চড়া সুদে ঋণ দিতেন শ্রেষ্ঠী, বণিক, ধনী সম্প্রদায়। ঋণে জামিন হিসেবে সম্পত্তি না রাখতে পারলে বউ, বোন বাঁধা রাখতে হতো ঋণদাতার কাছে। এই মহিলাদের শ্রমের সঙ্গে দেহ দিতে হতো। এরপর ঋণ শোধ না হলে ঋণ গ্রহীতাকে দাস থাকতে হতো ঋণ দাতার কাছে। দারিদ্র্য ও দাসত্বের এই যন্ত্রণা ও দুঃখ ছিল ভয়ংকর। শ্রমজীবী শূদ্রদের জীবনও ছিল বিভীষিকাময়। দিন থেকে রাত কঠোর শ্রমের বিনিময়ে এক বেলা উচ্ছিষ্ট খাবার মিলতো। ব্রাহ্মণ গ্রন্থগুলোতে যাদের শূদ্র বলে ঘোষণা করা হয়েছিল বৌদ্ধ গ্রন্থে তারাই চণ্ডাল, নেসাদ, পুক্কুস নামে পরিচিত। পরিচয় পাল্টালেও ধনী মহাজনদের উৎপীড়ন একই রইলো।
শোষক-শাসক বা রাষ্ট্র গ্রাম থেকে সম্পদ সংগ্রহ করতো চার ভাবে। (১) উৎপন্ন ফসলের উপর কর (২) বাধ্যতামূলক শ্রম বা বেগার খাটা (৩) রাজার জন্য ফসলের অংশ সংগ্রহ (৪) রাজাকে দেওয়া আবশ্যিক কর। এই কর আদায় ছিল নিষ্ঠুর অত্যাচারমূলক। শারীরিক নির্যাতন, সম্পত্তি লুণ্ঠন, ঘর-বাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া, নারীদের উপর অত্যাচার - কি না হতো। এই অত্যাচারের শিকার শুধু গ্রামের কৃষকরা হতো না; অন্যান্য বৃত্তিজীবী যেমন কুট্টক (ছুতোর), কর্মার (কামার), মোদক (মাটি কাটার শ্রমিক), কুম্ভকার, রজ্জুবর্তক (দড়ি শ্রমিক)-রাও উৎপীড়িত হতো। বোঝার ওপর শাকের আঁটির মতো মহাজনদের ঋণের বোঝা তো ছিলই। কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে পাচ্ছি, মৌর্য সাম্রাজ্যে সুদের হার ছিল শতকরা বার্ষিক ২৪০ মুদ্রা। পরে তা অর্ধেক করা হয়েছিল।
এই সামাজিক পরিস্থিতিতে দেখা যেতো, কোনও ঋণ গ্রহীতা যদি বুঝতে পারতো তার পক্ষে ঋণ শোধ করা অসম্ভব, তখন ক্রীতদাস জীবনের দুঃখ-যন্ত্রণা থেকে বাঁচতে বৌদ্ধ ভিক্ষু হয়ে যেতো। এর ফলে শ্রেষ্ঠী ও মহাজনদের মধ্যে বুদ্ধের বিরুদ্ধে ক্ষোভ জমে ওঠে। অবস্থা সামাল দিতে বুদ্ধ ঘোষণা করেন, "ঋণী ব্যক্তিকে প্রবজ্যা (ভিক্ষু হতে দীক্ষা) দেওয়া অনুচিত।" (মহাবগ্গ ১৩/৪/৮ ও বিনয়পিটক)
ক্রীতদাসরা তাদের দাসত্ব জীবনের দুঃখ-যন্ত্রণা এড়াতে ভিক্ষু হতে শুরু করেন। দাস মালিকরা বুদ্ধের উপর ক্ষুব্ধ হলেন। দাস মালিকদের রাগ থামাতে বুদ্ধ আবার ঘোষণা করলেন "ক্রীতদাসদের জন্য প্রবজ্যা অনুচিত।" (মহাবগ্গ ১/৩/৪/৯) জেনে রাখা ভালো, বৌদ্ধ সংঘে ক্রীতদাসরা শ্রম বিনিয়োগ করতো খাবারের বিনিময়ে। মগধ সম্রাট বিম্বিসারের বহু সেনা যুদ্ধে যেতে অস্বীকার করে বৌদ্ধ ভিক্ষু হতে শুরু করে। বিম্বিসারের রাজশক্তি সেনা নির্ভর। সুতরাং বুদ্ধ ধর্মের অনুগামী বিম্বিসারের বুদ্ধের প্রতি ভক্তি-শ্রদ্ধা গেলো উবে। তিনি রাজসভার মন্ত্রীদের সঙ্গে পরামর্শের পর ঘোষণা করলেন, সেনাদের ভিক্ষু হিসেবে দীক্ষা দিলে বৌদ্ধ গণ বা সংঘ অবিলম্বে ধুলোয় মিশিয়ে দেওয়া হবে। বৌদ্ধ ধর্মগুরুর শিরোচ্ছেদ করা হবে। বিম্বিসারের ক্রোধ থেকে বাঁচতে ও সংঘকে বাঁচাতে বুদ্ধ আর এক দফা ঘোষণায় জানালেন, "রাজ সৈনিকদের প্রবজ্যা অনুচিত।" (মহাবগ্গ ১/৩/৪/২, বিনয়পিটক)
শ্রেণীগতভাবে বুদ্ধ গোষ্ঠীপতি ধনী পরিবারের সন্তান। সেভাবেই বড় হয়েছেন। গরীবদের বাস্তব জীবনের চরম দারিদ্র ও দুঃখের ভয়ংকর অভিজ্ঞতা তাঁর ছিল না। দুঃখকে তিনি অনুভব করেছিলেন বৃদ্ধ, অসুস্থ ও মৃত্যু দেখে। এই দেখে তিনি মানসিক আঘাত পেয়েছেন। দুঃখের কারণ খুঁজতে গিয়ে তিনি তৃষ্ণা ও অবিদ্যাকে দায়ী করেছেন। এসবই পুরোন কথা। দুঃখকে জয় করতে কিছু শীল বা নীতি পালনের উপদেশ দিয়েছেন। এ নিয়েও আমরা আগে আলোচনা করেছি। কিন্তু যে কথা গভীরভাবে বলা দরকার, সেটা বোধহয় কিছুটা অ-বলাই থেকে গেছে।
শ্রমজীবী বা ক্রীতদাস পরিবারে জন্মালে বুদ্ধ উচ্চ বর্ণের শোষণ ও অত্যাচারের প্রতিটি দিক অনুভব করতে পারতেন। অত্যাচারের কারণগুলো, দুঃখের কারণগুলো তাঁর কাছে অন্যভাবে ধরা পড়তো। তৃষ্ণা ও অবিদ্যার সঙ্গে অত্যন্ত শোষণ ও উৎপীড়নকেও দায়ী করতেন। কিন্তু ধরা পড়েনি। অথবা পরিব্রাজক জীবনে ও ধর্মগুরু হয়ে যখন সাধারণের সঙ্গে মেশার সুযোগ পেলেন, তখন দুঃখের প্রকৃত কারণ তাঁর কাছে ধরা পড়েছে। কিন্তু রাজতন্ত্র ও সামন্ত্রতন্ত্রের বিরুদ্ধে করার বা বলার মতো কোনও বাস্তব অবস্থা ছিল না। শোষক-শাসক-রাষ্ট্রশক্তির বিরোধিতা করার চিন্তা ছিল আত্মহননের নামান্তর। ফলে তাঁকে কিছু কিছু ক্ষেত্রে আপস করতে হয়েছিল।
বুদ্ধের যুগেই বণিক শ্রেণী জাতে ওঠে। তাদের রমরমা বাড়ে। বৈদিক যুগে বা ব্রাহ্মণদের বোলবোলাওয়ের যুগে বণিক বা শ্রেষ্ঠী শ্রেণীকে 'বৈশ্য' বলা হতো। তারা ছিল উচ্চ বর্ণের সমাজে তৃতীয় শ্রেণীর নাগরিক। বুদ্ধ এই উঠে আসা নতুন শ্রেণীর স্বার্থ রক্ষা করতে যে যথেষ্ট সচেতন ছিলেন, তার প্রমাণ মেলে 'বৌদ্ধ সুত্তনিপাত' গ্রন্থে। গ্রন্থটিতে একটি নিষেধের তালিকা আছে। এই তালিকা অনুসারে দেখা যাচ্ছে, ক্রীতদাস প্রথা, সুদ আদায়ের নামে ক্রীতদাস তৈরির ফাঁদ, বণিক শ্রেণীর চিত্ত বিনোদনের জন্য গণিকাবৃত্তি নিন্দিত হয়নি। বণিক সমাজের স্বার্থেই নিন্দিত হয়নি; বরং ঋণ শোধ না করা, দাসত্ব থেকে মুক্তির উপায় হিসেবে পালিয়ে যাওয়াকে অন্যায় বলে ঘোষণা করা হয়েছে। বুদ্ধের পশু হত্যার বিরোধিতা বণিক শ্রেণীর স্বার্থকেই রক্ষা করেছিল, কারণ ওই সময় সম্পদ হিসেবে পশুকে গণ্য করা হতো। সব মিলিয়ে বৌদ্ধ ধর্মকে ব্যক্তিগত সম্পত্তির মালিক, বণিক-মহাজন, রাজশক্তি তাদের সহায়ক শক্তি বলে মনে করেছিল। ফলে শ্রেষ্ঠী থেকে সম্রাট প্রত্যেকেই উদার হাতে স্বর্ণ মুদ্রার ঢের লাগিয়ে দিয়েছিল, উদ্যান দিয়েছিল, সংঘ তৈরি করে দিয়েছিল, উপঢৌকন হিসেবে দিয়েছিল প্রচুর ক্রীতদাস। বৌদ্ধ ধর্ম হয়ে পড়েছিল রাজধর্ম, উচ্চ বর্ণের ও উচ্চবিত্তের ধর্ম। যদিও একথাও ঠিক যে, শোষিত শূদ্ররাও বৌদ্ধ ধর্মকে গ্রহণ করে ঘৃণ্য জীবন থেকে মুক্তি পেয়েছিল।
উচ্চ বর্ণের ভারতীয় দার্শনিক ও ঐতিহাসিকরা বুদ্ধকে উপজাতীয় থেকে ক্ষত্রিয় বানিয়ে ছেড়েছেন। শুদ্ধোধনকে বানালেন রাজা। অথচ বুদ্ধের সময়কার ব্রাহ্মণ ও উচ্চ বর্ণের মানুষদের কাছে বুদ্ধ ছিলেন নীচ বংশীয় মানুষ। বিভিন্ন পালি গ্রন্থে বুদ্ধকে 'বৃষল' বা 'নীচ জাতীয়' বলে উল্লেখ করা হয়েছে। রাজা থেকে বণিকরা যখন বুদ্ধকে ধর্ম গুরু হিসেবে গ্রহণ করলেন, তখন তাদের আত্মসম্মানের স্বার্থে বুদ্ধকে রাজা বলে ঘোষণা করেন। পরের পর্যায়ে তাঁকে ভগবান বিষ্ণুর অবতার, তারপর ভগবানেরও ভগবান বানানো হলো। নিরীশ্বরবাদী বুদ্ধ ঈশ্বর হয়ে গেলেন। আমরা ভারতীয়রা ব্রাহ্মণ্যবাদী দার্শনিকদের চেপে যাওয়া তথ্য ও ছাপা তথ্যের দ্বারা বুদ্ধকে ততটাই জানলাম, যতটা তাঁরা জানালেন আমাদের বুদ্ধু বানাতে।"
- অলৌকিক নয়, লৌকিক (৫ম)
........................................................................................
মাওবাদীদের ভয়ে বিহার থেকে শুরু করে আরও অনেক রাজ্যে সম্পদশালী শোষকরা রণবীর সেনা, লোরিক সেনা, ভূমি সেনা ইত্যাদি নামে প্রাইভেট আর্মির সমান্তরাল শাসন বজায় রেখেছে। তথাকথিত সংসদীয় গণতান্ত্রিক দেশটিতে এই সমান্তরাল ব্যবস্থা নির্দ্বিধায় যুগের পর যুগ ধরে চালানো হচ্ছে আর এই ধনী জোতদারদের প্রাইভেট আর্মির সদস্যরা এমন কোনো অত্যাচার বাকি রাখেনি যেগুলো দেশটির ভূমিহীন কৃষক, নিম্নবর্ণের হিন্দু আর আদিবাসীদের উপর চালানো হয়নি।
.......................................................................................
বিয়ের অনুষ্ঠানের মধ্যে একটা অদ্ভুত জগাখিচুড়ি আছে। কিছু কিছু বৈদিক অনুষ্ঠান বৈদিক যুগের শেষাংশে রয়ে গেছে, সঙ্গে কিছু বৈদিক মন্ত্রও। কিন্তু তার সঙ্গে এসে জুড়েছে বিস্তর লৌকিক অনুষ্ঠান; শুধু স্ত্রী-আচারে নয়, বিয়ের অপরিহার্য অঙ্গ হিসাবেও এগুলি যথেষ্ট গুরুত্ব পায়। যুগে যুগে বিকশিত হয়ে পরিবর্ধিত আকারে এখন যা দাঁড়িয়েছে তার মধ্যে আছে বরকে আসনে বসিয়ে সবস্ত্রা সালংকারা কন্যা দান করা হয়। হোম হয়, আবার বহু পরবর্তী যুগের সংযোজন শালগ্রাম শিলা বিষ্ণুর প্রতীক হয়ে সাক্ষী থাকে, অগ্নির মতো। বৈদিক যুগের মতো পাণিগ্রহণ ও সপ্তপদী গমন হয়। যোক্তবন্ধন অর্থাৎ বর-কনের কাপড়ের শেষ প্রান্তে গিট বাঁধা হয়। মালাবদল অর্বাচীন কালের সংযোজন। পুরানো কতকগুলো গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠান সংক্ষিপ্ত আকারে রয়ে গেছে, যেমন অশ্বারোহন। এটি বৈদিক; বর একখণ্ড পাথর বধূর সামনে রাখলে সে তার ওপরে দাঁড়ায়। তখন বর বলে, ঐ পাথরের মত স্থির হয়ো (এহি অস্মানমতিষ্ঠ অম্মেব ত্বং স্থিরা ভব - কৌশিকসূত্র ১০/৭৭)। তেমনই বহু প্রাচীনকালের রীতি অনুসারে ধ্রুব নক্ষত্র ও অরুন্ধতী দর্শনের স্মৃতিমাত্রই অবশিষ্ঠ আছে, সত্যিকার নক্ষত্র দুটিকে এখন বেশি কেউ চেনেও না। দেখেও না। কিন্তু মন্ত্রটি জরুরি, সেটি বর বলে: আকাশ ধ্রুব, পৃথিবী ধ্রুবা, এই জগৎ ধ্রুব, ধ্রুব এই পর্বতরা, এই স্ত্রী পতিকূলে ধ্রুবা (আশ্বলায়ন গৃহ্যসূত্র ১/৭/২২)। লক্ষণীয়, ধ্রুবত্ব, স্থিরত্ব শুধু বধূটির কাছেই অপেক্ষিত। সে-ই প্রতিজ্ঞা করবে আমি পতিকূলে ধ্রুবা হবো, অরুন্ধতীর দ্বারা আমি অবরুদ্ধ। অর্থাৎ প্রাচীন পতিব্রতা ঋষিপত্নী আমাকে পতিকূলে স্থির থাকবার জন্যে অবরুদ্ধ করেছেন। পাণিগ্রহণের পরে বধূর শুদ্ধির জন্যে বর কিছু মন্ত্র পড়তো - ছ'টি আহুতি দিতো বিনা মন্ত্রে এবং বলে যেতো, 'এই নারীর চোখের পাতার চুল, মাথার চুল, চরিত্র, কথা, হাসি, দেহ ও বস্ত্রের রন্ধ্র থেকে নিঃসৃত রশ্মিকণা (আরোক) দন্ত, হস্ত, পদ, উরু, উপস্থ, জঙ্ঘাসন্ধিতে; যা কিছু ঘোর ও অশুচি আছে তার সর্বাঙ্গে, তা শুদ্ধ হোক।' আপনিই মনে আসে, পুরুষ কি স্বতই শুচি? আর যত অশুচিতা তা শুধু নারীর দেহে, মনে, আচরণে? তা শোধন করার দায় বা অধিকার কোথা থেকে পায় পুরুষ? আসলে তার চাই একটা শুচি কুমারী কন্যা এবং সম্ভাব্য অশুচিতার প্রতিকার করার স্পর্ধা শাস্ত্র জুগিয়েছে পুরুষকে। পুরুষের অশুচিতার সম্ভাবনা পর্যন্ত শাস্ত্রে স্বীকৃত নয়। এই বৈষম্যের ভিত্তিতেই শাস্ত্রে নিষ্পন্ন হয় বিবাহ এবং অনুষ্ঠানের পদে পদে এই বৈষম্য প্রকট হয়ে ওঠে। কন্যার পিতা ভাবী জামাতাকে আসন দিয়ে অভ্যর্থনা করে বলেন 'আপনাকে অর্চনা করছি' [অর্চয়িশ্যামো ভবন্তম] এবং জামাতা অনুমতি দেয় 'হ্যাঁ, অর্চনা করুন' [ওম্ অর্চয়]। সম্প্রদানের মধ্যেও কন্যা ব্যক্তি থেকে বস্তু হয়ে ওঠে। যে বস্তুর তৎকালীন মালিক পিতা ভাবী মালিক জামাতার কাছে কন্যারূপ বস্তুটিকে দান করেন। সবস্ত্রা, সালংকারা এবং পণযৌতুক সহ। এর মধ্যেও প্রচ্ছন্ন থাকে বধূটির সামাজিক সত্তার অবমাননা, তাকে বস্তু রূপে হস্তান্তরিত করা হয়। বিয়ের প্রায় প্রতি পর্বে এই ধরনের অবমাননা অন্তর্নিহিত ছিল। একটিমাত্র মন্ত্রে কন্যার দীর্ঘ আয়ু কামনা করে বলা হয়েছে, 'তুমি সম্পদ ধারণ কোরো।' বলাবাহুল্য, এ সম্পদ তার পতিকূলেরই, কোনো সম্পত্তিতে কন্যার তো স্বতন্ত্র কোনো অধিকার ছিল না। একটি অনুষ্ঠানে কন্যা মাদুরে পা রাখবে, তখন উচ্চারিত হবে 'পতি দেবতা' এবং 'পতিযান কামনীয়'। অর্থাৎ কন্যা কামনা করছে যেন সে পতিলোকে যেতে পারে। যেটা লক্ষণীয়, তা হলো শাস্ত্রে অন্য দুটি যান আছে 'দেবযান' ও 'পিতৃযান'। অর্থাৎ দেবলোক থেকে মোক্ষ ও পিতৃলোক থেকে পুনর্জন্মের পথ। দেবতা ও পিতৃগণের মতো উচ্চ আসন সৃষ্টি হলো পতির এবং পত্নীর কামনা হলো: যেন সে পতিলোকে ঠাঁই পায়। লাজহোম (আগুনে খই দিয়ে হোম) অনুষ্ঠানে পতির দীর্ঘায়ু, শতবর্ষ পরমায়ু কামনা করে বধূ আর বলে তার শ্বশুরবাড়ির সকলের যেন শ্রীবৃদ্ধি হয় [দীর্ঘায়ুরস্তু মে পতিঃ শতং বর্ষাণি জীবত্বেধনতাং জ্ঞাতয়ো মম]। সপ্তপদীগমনের মন্ত্রগুলিতে উভয়ের মিলিত জীবনের শ্রীবৃদ্ধির কামনা আছে। পাণিগ্রহণের মন্ত্রে বর বধূকে বলে: 'আমার ব্রতে তুমি তোমার হৃদয় ধারণ করো, তোমার চিত্ত আমার চিত্তের অনুগামী হোক। বৃহস্পতি তোমাকে আমার জন্য নিযুক্ত করুন।' [মম ব্রতে তে হৃদয়ং দধাতু মম চিত্তমনু চিত্তং তেহস্ত।... বৃহস্পতিস্তা নিযুনক্তু মহাম- মানব গৃহ্যসূত্র ১/১০/১৩] লক্ষণীয়, বধূটিরও যে চিত্ত আছে, আগামী বিবাহিত জীবন সম্বন্ধে যে তারও কিছু স্বপ্ন, কিছু কামনা থাকতে পারে সে বিষয়ে শাস্ত্র ও সমাজ সম্পূর্ণ উদাসীন। এক সময়ে বর বধূ সম্বন্ধে প্রার্থনা করে, 'এর যে পতিঘাতিকা তনু তাকে ধ্বংস করো, এর যে পুত্রহীনা তনু, পশুহীনা তনু তা দূর হোক।' [যাস্যাঃ পতিঘ্নী তনুস্তামস্যা অপজহি, যাস্যা অপুত্রা তনূঃ, যাস্যা অপশব্যা তনস্তামস্যাঃ অপহতা]
- 'বিবাহ প্রসঙ্গে', সুকুমারী ভট্টাচার্য
........................................................................................
....ব্যথাতুর কণ্ঠে দেবী শোচনা সীতাকে বললেন - মা সীতা, এই মোহময় স্বর্গোদ্যানে আসলে আমরা সকলেই দুঃখের দেবী। নিপীড়ন আর লাঞ্ছনার ঈশ্বরী। রাজদুহিতা হিসাবে মর্তে তুমি ব্রাহ্মণদের কম্বুকণ্ঠে বেদপাঠ শুনেছ। শুনেছ শাস্ত্র, শ্রুতি, স্মৃতি, পুরাণ আলোচনা। পশুচারণজীবী আর্যদের ঋবেদে তুমি পুরুষ দেবতাদেরই শুধু আধিপত্য দেখতে পাবে। ইন্দ্র, বরুণ, পৃষা, সোম প্রমুখ দেবতাদের পাশে মনে রাখার মত কোন নারী চরিত্র পাবে না। এই সব প্রবল পরাক্রমশালী দেবতাদের পাশে স্মরণে থাকার মত একমাত্র দেবী-নারী হলেন ঊষা। যদিও ঊষা ছিলেন আর্যপূর্ব কৃষিভিত্তিক সিন্ধু সভ্যতার মহামাতৃকা দেবী। কৃষি উর্বরতাতন্ত্রের ধর্মাচরণে দেবী উষা, সিন্ধু সভতার কৌলিন্যে সর্বজন পূজিতা হলেও কালভেদে ঋকবেদে এই ঊষাই অপহৃতা এবং ইন্দ্র কর্তৃক ধর্ষিতা হন। সম্ভবত এই সব দৈব কাহিনী যাযাবর আর্যদের কাছে পরাভূত সিন্ধু বালাদের লাঞ্ছনারই ইতিবৃত্ত। সমাজ বিকাশের ধারা বেয়ে প্রতিটি পর্যায়ে নারী সম্পর্কে পিতৃতান্ত্রিক সমাজের দৃষ্টিভঙ্গী যেভাবে অধঃপতিত হয়েছে, পুরুষ শাসিত দেবতাদের স্বর্গেও মাতৃদেবীরা সমান মাত্রায় নিপীড়নে, অপমানে ক্ষতবিক্ষত হয়েছেন।
দুর্গতিনাশিনী দেবী দুর্গার উপাখ্যান তো তুমি জানো। স্বর্গ থেকে বিতাড়িত দেবতাদের পুনর্বাসিত করার কাহিনীতে মহিষাসুর হত্যার মধ্য দিয়ে যতই মহিমান্বিত করা হোক দেবী দুর্গাকে, অতি সূক্ষ্মভাবে যৌন বিকৃতির কুৎসিত ইঙ্গিত লুকানো আছে এই কাহিনীতেও। শৌর্যে বীর্যে পরাক্রান্ত মহিষাসুরের প্রতাপে স্বর্গ থেকে বিতাড়িত হয়েছিলেন দেবতারা। নির্বাসিত দেবতাদের সম্মিলিত কাপুরুষতা থেকে জন্ম নিলেন মহাদেবী দুর্গতিনাশিনী দুর্গা। যদিও পুরাণে কথিত আছে দেবতাদের সম্মিলিত তেজোরাশি থেকে জন্ম নিলেন তিনি। কিন্তু পরাভূত দেবতাদের তেজোরাশি তো মহিষাসুরের প্রবল পরাক্রমেই বাষ্পীভূত হয়ে গেছে, স্বভাবতই পরাভূত দেবতাদের সম্মিলিত কাপুরুষতা বললেই বাস্তবতার কাছাকাছি হবে। তো, দেবতাদের সম্মিলিত ক্রোধ মহিষাসুরকে পরাভূত করতে পারলো না কেন? পুরাণে যাই থাক, কৃষি সভ্যতার স্থপতি অনার্যদের মেধা এবং কুশলতার কাছে যাযাবর আর্যরা ছিল অসহায়। তাদের ক্রোধে ছিল না সৃজনশীল শ্রমের সর্বগ্রাসী দহন, যা শত্রু জয়ের অমোঘ শক্তি হয়ে উঠতে পারে। দুর্গাকে সমস্ত পুরুষ দেবতাদের সম্মিলিত শক্তি এবং অস্ত্রে সুসজ্জিত করা হলো। ইন্দ্র দিলেন বজ্র। বিষ্ণু দিলেন চক্র। দেবাদিদেব মহাদেব দিলেন ত্রিশূল। সমুদ্র দেবতা বরুণ বহুমূল্য রত্নরাজি আর স্বর্ণালঙ্কারে দেবী দুর্গার সর্বাঙ্গে দিলেন দ্যুতিময় সৌন্দর্য। মা সীতা, এ প্রশ্ন তোমার মনে কোনদিন আসেনি যে রণংদেহি দুর্গাকে সুরাপূর্ণ পানপাত্র কেন দিলো কুবের? দেবী দুর্গাকে মোহিনী রূপ দিলো কে? মোহিনী রূপ, যা মাতৃভাবকে, মহাশক্তিকে মোহময়ী করে। প্রবল পরাক্রান্ত বীর্যবান সৃষ্টিশীলতাকে নিস্ফলা যৌন কামনায় অস্থির করে, মুহূর্তের ভ্রান্তিতে টেনে নেয় স্খলনের পিচ্ছিল পরাজয়ের পথে। সেই মহাশক্তির রক্তমাংস অস্থি-মজ্জার শরীরকে প্রাধান্য দিয়ে, যৌন প্ররোচনার ইঙ্গিতে তাঁকে সাজিয়ে তোলার প্রয়োজন কেন হয়? ঈশ্বরের রাজ্যেও নারীত্বের মহিমান্বিত বৈশিষ্ট্যগুলি এখানে প্রাধান্য পায় না। দেবীমাহাত্ম্য প্রতিষ্ঠার নামে এখানেও তাঁকে সাজানো হয় ব্যভিচারী পুরুষ-শাসিত সমাজের লুব্ধতার দৃষ্টিতে।
অমল শৈশবে তুমি তো তোমার পিতামহীর কাছে সমুদ্র মন্থনের উপাখ্যান শুনেছ। ইন্দ্রকে দুর্বাসা দিয়েছিলেন পুষ্পমাল্য। ভোজন রসিক হস্তী ঐরাবত তা মুহূর্তে মুখগহ্বরে নিক্ষেপ করে পরমানন্দে চিবিয়ে ফেলেছিলেন। ক্রুদ্ধ দুর্বাসা সম্পদ আর শস্যের দেবী লক্ষ্মীকে সমুদ্রের গভীরে ডুব দিতে বলেছিলেন ইন্দ্রকে শ্রীহীন, ঐশ্বর্যহীন করতে! মন্দার পর্বত আর বাসুকী নাগের সাহায্যে দেবতা এবং অসুরদের সম্মিলিত মন্থন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে উঠে আসেন অমৃতকুম্ভ কাঁখে দেবী লক্ষ্মী। একই সাথে উঠে আসে সুতীব্র গরল। অমৃতকুম্ভের দখল নিতে শুরু হয় ভয়ঙ্কর যুদ্ধ। যুদ্ধে পরাভূত হলো দেবতারা। তখন নারায়ণ মোহিনী রূপ ধারণ করে দাঁড়ালেন বিজয়ী অসুরকূলের মুখোমুখি। অস্ত্র হাতে পুনরাক্রমণের পরিবর্তে সালঙ্কারা মোহিনী যুবতী কেন? কেন বীর রসের পরিবর্তে শৃঙ্গার রস? কেন সমুদ্র মন্থনে ক্লান্ত, ভয়ঙ্কর রণে বিজয়ী উন্মত্ত অসুরকুলের সামনে আদি রসের কদর্য প্রলোভন? মোহিনী কে? দেব চিকিৎসক ধন্বন্তরীর কনিষ্ঠা ভগ্নী। বিভ্রমের দেবী। সম্মোহনের দেবী। তো, সেই অপরূপা মোহিনী নিজেই দায়িত্ব নেন অমৃত বণ্টনে। শর্ত একটাই; অসুরদের চোখ বুজে থাকতে হবে, ধৈর্যের এই পরীক্ষায় যে সবশেষে চোখ খুলবে, মোহিনী তারই দয়িতা হবেন। চক্ষুষ্মান অসুরকুল মুহূর্তের লালসায় চোখ বন্ধ করে। এই অবসরে অমৃতকুম্ভ নিয়ে সরে পড়েন বিভ্রমের দেবী মোহিনী। ঈশ্বরের রাজ্যেও কোন আব্রু নেই। একেবারে সরাসরি প্রস্তাবনা। এখানেও দেবী-নারীর যৌবন ধর্ষকামের টোপ হিসাবে ব্যবহৃত।
মা-সীতা, দুঃখ পেয়ো না। এক নিদারুণ লজ্জাজনক সত্য বলবো তোমায়। দেবজ্ঞানে যে পতিকে তুমি পুজো করেছ আজন্মকাল, ত্রেতা যুগে তিনিই হলেন বিষ্ণুর অবতার। বিষ্ণু অসংখ্য দার পরিগ্রহ করেছিলেন। তার মধ্যে অন্যতম ছিলেন তিনজন। গঙ্গা, সরস্বতী এবং লক্ষ্মী। স্রোতস্বিনী নদী সমস্ত জঞ্জালকে নিরন্তর বহমানতায় ভাসিয়ে নিয়ে যায়, দূষণমুক্ত করে প্রকৃতিকে। ব্যবহারিক এই বাস্তবতা থেকে পবিত্রতার প্রতীক হিসাবে দেবী গঙ্গা পূজিতা হন। বুদ্ধিবৃত্তি এবং প্রজ্ঞার দেবী সরস্বতী। শস্য আর ঐশ্বর্যের দেবী লক্ষ্মী। রূপে-গুণে পবিত্রতায় গঙ্গা ও সরস্বতী মহিয়সী হলেও দুজনের কেউই পতি দেবতার হৃদয়েশ্বরী হতে পারেননি। তিন সতীনের পারস্পরিক ঝগড়ার সুযোগ নিয়ে বিষ্ণু শিবের অঙ্কশায়িনী হতে দিলেন গঙ্গাকে। বিকৃত কামনায় অস্থির মহাবৃদ্ধ ব্রহ্মার হাতে তুলে দিলেন দেবী সরস্বতীকে। শুধু অর্থের দেবী লক্ষ্মী থাকলেন বিষ্ণুর হৃদয়েশ্বরী হয়ে। সমাজ বিকাশের যে অধঃপতিত পর্যায়ে পুরুষ শাসক সামাজিক প্রতিষ্ঠা আর প্রতিপত্তির জন্য নারীকেও হস্তান্তরযোগ্য পণ্য বলে মনে করতে শুরু করেছিল, সামাজিক সেই কদর্য বাস্তবতাই প্রতিফলিত হয়েছে স্বর্গরাজ্যের কল্পনায়।....
- 'পুনর্বার সীতা', দেবু দত্তগুপ্ত
......................................................................................
....বৈদিক দেবতাদের মধ্যে প্রধানতম হলেন ইন্দ্র। অনেক সময়েই তাঁকে যুযুধান আর্যভাষী বাহিনীর নায়করূপে দেখা যায় যিনি-
(ক) শতদ্বার যুক্ত প্রস্তর নির্মিত নগরীসমূহ ভস্মসাৎ করেছিলেন;
(খ) হরিযুপীয়া (হরাপ্পা) নগরের উপকণ্ঠে দাস বংশীয় রাজন্যবর্গ ও সৈন্যদেরকে ধ্বংস করেছিলেন;
(গ) মুরদেবাঃ-শিশুদেবাঃদের নগরী লুন্ঠন করেছিলেন।
(ঘ) দাস রাজাদের পুরনারীদেরকে গণধর্ষণে বিধ্বস্ত করার নেতৃত্ব দিয়েছিলেন;
(ঙ) স্বয়ং ঊষাদেবীকে ধর্ষণ করেছিলেন;
(চ) বৃত্র নামক ত্রিশীর্ষ অসুরকে বধ করেছিলেন;
(ছ) কৃষ্ণত্বক দাস-অহি বংশীয়দের পৃষ্ঠত্বক উন্মীলন করেছিলেন;
(জ) দাস বংশীয়া গর্ভিনী নারীদের হত্যা করেছিলেন;
(ঝ) যতিদের নিধন করে উল্লাস প্রকাশ করেছিলেন।
মন্ত্রদ্রষ্টা বৈদিক ঋষিরা এতসব 'মহৎ' কাজে ব্যাপৃত থাকা ইন্দ্র দেবতার স্তুতিতে মুখরই হয়েছেন!....
- 'ধর্ম ও ভারতবর্ষ: আদি-পর্বের রূপরেখা', পল্লব সেনগুপ্ত
বৈদিক সাহিত্যের নানা জায়গায় উল্লেখ আছে ইন্দ্র নিজের প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতে অনার্য সভ্যতা আক্রমণের পর তাদের ধর্মীয় সাধকদের হিংস্র নেকড়ে দিয়ে খাওয়াতো।
[সূত্র : ঐ]
বর্তমান প্রজন্মের চাড্ডিরা ইয়োগা এর আবিষ্কারক হিসেবে গায়ের জোরে আর্যদের প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করলেও এটির আবিষ্কারক ছিল অনার্য সভ্যতার লোকেরা, যা উদ্ধার করা প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলোর দ্বারাই প্রমাণিত।
[সূত্র: ঐ]
....ঊষা এবং বৃত্র সম্পর্কে যে উল্লেখগুলি উপরে করা হয়েছে, সে বিষয়ে আরো কিছু বলার আছে। দামোদর ধর্মানন্দ কোশাম্বী, উষাকে হরাপ্পীয় মাতৃ দেবতার সঙ্গে সমীকৃত করেছেন। তাঁর মতে ইন্দ্র কর্তৃক ঊষার ধর্ষণ প্রকৃতপক্ষে আর্যভাষী সৈন্যদের দ্বারা হরাপ্পীয় নগরগুলির নারীদের উৎপীড়নের দ্যোতক। যাযাবর আর্যভাষী গোষ্ঠীগুলিতে স্বাভাবিকভাবেই আনুপাতিক হারে নারীর সংখ্যা কম থাকায় তাঁরা দেবতার কাছে প্রার্থনার মন্ত্রেও পরনারী সম্ভোগের বাসনা প্রকাশ করেছিলেন এবং বাস্তবে তা ঘটেছিল। উত্তরকালের হিন্দু কৃষ্টিতে স্বামীকে 'আর্যপুত্র' বলে সম্বোধন করাটা তারই সূচক (অর্থাৎ স্ত্রীরা আর্য নন)। প্রাক বৈদিক দেবদেবীরা ধীরে ধীরে আর্যভাষী সমাজে মিশে গেছেন, প্রাগার্য (অর্থাৎ হরাপ্পীয় এবং অন্যান্য প্রাচীন জাতিকোমগুলির) নারীরা আর্যভাষীদের 'বধূ' (যার প্রকৃতি-প্রত্যয়গত অর্থ - বহন করে আনা লুণ্ঠিতা নারী) হয়ে আসার সুবাদে। ইন্দ্র কর্তৃক ঊষা ধর্ষণের কাহিনীটি তাই সবিশেষ সামাজিক তাৎপর্যময় এবং ধর্মীয় গুরুত্বসম্পন্ন তো বটেই।....
[ঐ]
সিন্ধু সভ্যতায় একটা নোংরা প্রথা প্রচলিত ছিল। শস্যের ফলন বৃদ্ধির জন্য তারা নারীদের বলি দিতো। আর বলি দেয়ার আগে ঐ নারীদের সাথে সম্ভোগ করা হতো এই বিশ্বাসে যে, এতে শস্যের সাথে সাথে সন্তানও বৃদ্ধি পাবে। শস্যের ফলন বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে যৌন কর্ম সম্পাদনের এই নোংরা রীতি তাদের কাছ থেকে আর্যরা গ্রহণ করেছিল।
[সূত্র: ঐ]


 
 
 
Comments