শকুন্তলা দেবীর ভণ্ডামি উন্মোচন

 

কলকাতা তথা তামাম ভারতবর্ষের জ্যোতিষীরা দ্বিতীয় বিশাল আঘাত পেলেন যখন মানবী কম্পিউটার এবং ভারতবর্ষের বৃহত্তম জ্যোতিষ সংস্থা 'Indian Institute of Astrology'-র পৃষ্ঠপোষক, জ্যোতিষ সম্রাজ্ঞী শকুন্তলা দেবী আমার সরাসরি খোলামেলা চ্যালেঞ্জে সাড়া না দিয়ে কলকাতা ছেড়ে পালালেন। এতে তিনি ভরাডুবির হাত থেকে বাঁচলেও ডোবালেন তাঁর মুখাপেক্ষী সারা ভারতবর্ষের কয়েক হাজার জ্যোতিষীকে। শকুন্তলা দেবী বাস্তবিকই চতুর। প্রথমবার আকাশবাণীর অনুষ্ঠানে তিনি আমার বিরুদ্ধে হাজির হননি। জানতেন হাজির না হওয়ার যে অপমান, তাঁর চেয়ে বহুগুণ বড় মাপের অপমান তাঁর জীবনে নেমে আসবে যদি হাজির হয়ে পরাজিত হন। দ্বিতীয়বার আমার চ‍্যালেঞ্জের মুখে পড়ে গুছোন জ্যোতিষ ব্যবসা ফেলে স্রেফ পালিয়েছিলেন। পালাবার তাড়ায় গ্রেট ইস্টার্ণ হোটেল থেকে নিজের জিনিসপত্তর নিয়ে যাওয়ার মতও সময় দিতে পারেন নি। ৪ ফেব্রুয়ারী, '৮৭ কলকাতার সান্ধ্য দৈনিক 'ইভিনিং ব্রিফ'-এর পাতা জুড়ে 'দ্য মিসটিক্যাল লেডি অব দ্য কমপিউটার' শীর্ষকে তথাকথিত 'হিউম্যান কম্পিউটার' শকুন্তলা দেবীর ছবি ও সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়। সাক্ষাৎকারের এক জায়গায় শকুন্তলা দেবী বলেছেন, 'অ্যাস্ট্রোলজি ইজ অলসো এ পার্ট ম্যাথামেটিক্স'। অর্থাৎ জ্যোতিষ অংকেরই একটি শাখা। অন্যত্র বলেছেন, 'অ্যাস্ট্রোলজি ইজ দ্য কিং অব অ্যাপ্লায়েড সায়েন্স'। অর্থাৎ কিনা জ্যোতিষ হলো ব্যবহারিক বিজ্ঞানের রাজা। শকুন্তলা দেবীকে সাক্ষাৎকার গ্রহণকারী প্রশ্ন করেছিলেন, "আপনি কি কোনও অনুষ্ঠানে কখনও অংক কষায় ভুল করেছেন?" শকুন্তলাদেবীর উত্তর, 'আই হ্যাভ নেভার হ্যাড এনি স্লিপ আপস বিকজ আই অ্যাম টু কনফিডেন্ট অব মাইসেলফ।'

আমি কখনও কোনও ভুল করিনি, কারণ আমার নিজের উপর অতিমাত্রায় বিশ্বাস আছে।

মানুষের স্মৃতি বড়ই দুর্বল। সময়ে তাই অনেক কিছুরই বিস্মরণ ঘটে। কিন্তু, শকুন্তলা দেবীর স্মৃতি তো আজ কিংবদন্তী। গিনিজ বুক অব রেকর্ডস-এ তাঁর নাম জ্বলজ্বল করছে। এমন অসাধারণ স্মৃতিশক্তির অধিকারিণী মহিলাটিকে বিনীতভাবে ১৯৭২ সালের একটি অনুষ্ঠানের কথা মনে করিয়ে দেওয়া যেতে পারে। দিনটি ছিল সম্ভবত ২ আগস্ট। স্থান - কলকাতা জেনারেল পোস্ট অফিসের করেসপনডেন্স হল। শকুন্তলা দেবীকে দিয়েই অনুষ্ঠান। তখনও শকুন্তলা দেবী পেশাদার জ্যোতিষী হয়ে ওঠেন নি, হয়ে ওঠেন নি ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অফ অ্যাস্ট্রোলজির সম্মানীয় পৃষ্ঠপোষক। সেদিনের অনুষ্ঠানে শকুন্তলা দেবী অংক কষতে গিয়ে বার বার পর্যুদস্ত হচ্ছিলেন, বিপর্যস্ত হচ্ছিলেন। এই অসাধারণ মুহূর্তের সাক্ষী ছিলেন পোস্টমাস্টার জেনারেলসহ কয়েক'শ মানুষ।

শকুন্তলা দেবীর আগেও অনেকেই মুখে মুখে অংক কষার ক্ষমতা দেখিয়েছেন। এঁদের মধ্যে রামানুজন এবং সোমেশ বসুর নাম তো অংক প্রিয়দের প্রায় সকলেরই জানা। শকুন্তলা দেবী এবং অন্য যাঁরাই মুখে মুখে বিশেষ ধরনের কিছু অংক কষেন তারা সেগুলো কষেন অংকের কিছু সূত্রের সাহায্যে। এই সূত্রগুলো জানা থাকলে এবং কঠোর অনুশীলন করলে ক্লাস এইটের মধুও 'হিউম্যান কম্পিউটার' হয়ে উঠতে পারে।

১৯৮৭-৮৮ সালে বিভিন্ন ভাষাভাষি কিছু পত্র পত্রিকায় মুখে মুখে অংক কষার সূত্র নিয়ে লিখেছি। এখানে সেই বিষয়ে আলোকপাত করা উচিত হবে না, তাই আবার আমরা জ্যোতিষী শকুন্তলা দেবীর আলোচনায় এদিকে যাচ্ছি। 

শকুন্তলা দেবীর সাক্ষাৎকারটির পরিপ্রেক্ষিতে আমি পরের দিনই 'ইভনিং ব্রিফ' পত্রিকা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে দেখা করে জানাই শকুন্তলাদেবীর বক্তব্যকে চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছি। জ্যোতির্বিদ্যা ও জ্যোতিষশাস্ত্র এক নয়। জ্যোতির্বিদ্যার বিষয় গ্রহ-নক্ষত্রের অবস্থান, প্রকৃতি ইত্যাদি নিরূপণ করা। আর জ্যোতিষশাস্ত্রের বিষয় হলো মানবদেহে গ্রহ-নক্ষত্রের প্রভাব নিরূপণ করা। দু'টো সম্পূর্ণ ভিন্ন ব্যাপার। বহু পরীক্ষার মধ্য দিয়ে বর্তমানে জ্যোতির্বিদ্যা বিজ্ঞানরূপে প্রতিষ্ঠিত। জ্যোতিষশাস্ত্রকে কিন্তু বিজ্ঞান স্বীকার করে না। বিজ্ঞান স্বীকার করে মানুষের সুখ-দুঃখের কারণ আকাশের গ্রহগুলোর মধ্যে নিহিত নেই, নিহিত রয়েছে সামাজিক ও আর্থিক ব্যবস্থার উপর। শকুন্তলা দেবী জ্যোতিষকে 'ব্যবহারিক বিজ্ঞানের রাজা' এবং 'অংকশাস্ত্রের শাখা' ইত্যাদি মিথ্যে ও উদ্দেশ্যমূলক কথা বলে মানুষকে বিভ্রান্ত করছেন এবং বাড়াচ্ছেন নিজস্ব ব্যাংক ব্যালেন্স। শকুন্তলা দেবীকে চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছি, তিনি প্রমাণ করুন তাঁর কথাগুলো সত্যি। শুধু শুকনো আলোচনা নয়; শকুন্তলা দেবীকে কয়েকজনের হাত, রাশিচক্র বা জন্ম সময় দেখে তাঁদের অতীত ও বর্তমান সম্পর্কে কিছু প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে। প্রশ্নগুলো হবে খুবই সহজ-সরল। জাতকের আয়ু, আয়, বিয়ে, শিক্ষা, কর্মক্ষেত্র - এইসব প্রচলিত বিষয়েই তাঁর কাছে প্রশ্ন রাখবো। শতকরা ৮০ ভাগ প্রশ্নের উত্তর দিতে পারলেই তাঁকে আমি ৫০,০০০ টাকা দেবো। এই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে হলে শকুন্তলা দেবীকে জামানত হিসেবে ৫০০০ টাকা জমা দিতে হবে।

চ্যালেঞ্জ জানানোর পর আমি যাতে পিছিয়ে না আসতে পারি তার জন্য পত্রিকা কর্তৃপক্ষ আমাকে দিয়ে একটি প্রতিজ্ঞাপত্র লিখিয়ে নেন। Evening Brief আমাকে দিয়ে একটি প্রতিজ্ঞাপত্র লিখিয়ে নিলেন, যা বাস্তবে একটি চুক্তিপত্র।

Evening Brief কর্তৃপক্ষ সুনিশ্চিত ছিলেন, শকুন্তলা দেবী তাঁর বিশ্ব বিখ্যাত ইমেজ ধরে রাখতে অবশ্যই আমার চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করবেন। অপরপক্ষে আমি চুক্তিপত্রে সাক্ষর দেওয়ার পর আমাকেও হালকাভাবে নিতে পারছিলেন না। অতএব তাঁরা যথেষ্ট রোমাঞ্চিত হলেন। শকুন্তলা দেবী চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করার পর সারা ভারতে হৈচৈ ফেলে দিয়ে কী করে কোথায় আমাদের দু'জনকে মুখোমুখি করা যায়, তার পরিকল্পনাও সেইদিনই শুরু হয়ে গেলো Evening Brief-এর প্রিয়ব্রত চ্যাটার্জির নেতৃত্বে। এ. মুখার্জি অ্যান্ড কোম্পানী প্রাইভেট লিমিটেডের কর্ণধার রঞ্জন সেনগুপ্ত এই পরিকল্পনার আলোচনায় অংশ নিলেন। ওরা দু'জনেই একমত হলেন - আমার ও শকুন্তলা দেবীর এই চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হওয়ার ঐতিহাসিক ঘটনাটিকে আক্ষরিক অর্থেই ঐতিহাসিক রূপ দিতে হবে। শকুন্তলা দেবী পরাজিত হলে সারা পৃথিবীর আগ্রহী মহলে যে বিশাল চাঞ্চল্য দেখা দেবে, তারই পরিপ্রেক্ষিতে দু'জনেই একমত হলেন এই চ্যালেঞ্জ নিয়ে যে অভূতপূর্ব প্রেস কনফারেন্স হবে তাতে কনফারেন্সের ব্যবস্থাপক হিসেবে 'ইভিনিং ব্রিফ', 'এ. মুখার্জি অ্যান্ড কোম্পানী'র সঙ্গে একটি বৃহৎ পত্রিকাগোষ্ঠিকেও সামিল করা হবে। আমন্ত্রণ জানানো হবে বহু বিশিষ্ট ব্যক্তি ও বিদেশী দূতাবাসগুলোকে।

শেষ পর্যন্ত প্রাথমিকভাবে মতৈক্যে আসা গেলো, (১) শকুন্তলা দেবী যে তারিখ দেবেন সেই তারিখই আমাকে মেনে নিতে হবে। (২) সেদিন কোনওভাবে আমি বা শকুন্তলা দেবীর মধ্যে কেউ হাজির না হলে, অনুপস্থিত ব্যক্তিকেই পরাজিত ও পলাতক হিসেবে ধরে নেওয়া হবে। (৩) চ্যালেঞ্জ হবে দুটি পর্যায়ে। প্রথম পর্যায়ে চ্যালেঞ্জে উভয়ে মিলিত হবার বেশ কিছুদিন আগে আমি চারজন জাতকের জন্ম সময় শকুন্তলাদেবীকে পৌঁছে দেবো। এই জাতকদের জন্ম সময়গুলো অবশ্যই হাসপাতাল বা অতি বিখ্যাত নার্সিংহোমের দেওয়া জন্ম সাল, তারিখ, সময় ও ঠিকানা সম্বলিত হতে হবে যাতে প্রয়োজনে যে কেউ সুনির্দিষ্টভাবে ওই ব্যক্তিদের চিহ্নিত করতে পারেন। (৪) প্রত্যেকের অতীত সম্পর্কে পাঁচটি করে প্রশ্ন রাখতে হবে আমাকে। (৫) ওই জাতকদের সেদিনের (চ্যালেঞ্জের দিনের) অনুষ্ঠানে হাজির করতে হবে আমাকে। (৬) শকুন্তলা দেবীর উত্তর শোনার পর জাতকরা সেই প্রতিটি উত্তর বিষয়ে মতামত দেবেন; জানাবেন উত্তর ঠিক, কি ভুল। ভুল হলে জানাবেন সঠিক উত্তরটা কী। (৭) উত্তর শুনে শকুন্তলা দেবী বা আমি সন্দেহ প্রকাশ করলে তিনজন সাংবাদিক এবং আমার ও শকুন্তলাদেবীর পক্ষে একজন করে অর্থাৎ মোট পাঁচজনকে নিয়ে একটি অনুসন্ধান কমিটি গঠন করা হবে ওই সাংবাদিক সম্মেলনেই। ওই কমিটি তিন দিনের মাথায় আবার এটি সাংবাদিক সম্মেলনে তাঁদের অনুসন্ধান রিপোর্ট পেশ করবেন। ওই রিপোর্ট আমাকে এবং শকুন্তলা দেবীকে মেনে নিতে হবে। (৮) শকুন্তলা দেবী মোট ২০টি প্রশ্নের মধ্যে ১৬টি বা তার বেশি প্রশ্নের উত্তর ঠিক দিতে পারলে শকুন্তলা দেবী জয়ী ঘোষিত হবেন। অন্যথায় আমি জয়ী ঘোষিত হবো। (৯) সাংবাদিক সম্মেলনের আগে ব্যবস্থাপকদের হাতে আমাকে পঞ্চাশ হাজার টাকা এবং শকুন্তলা দেবীকে পাঁচ হাজার টাকা জমা দিতে হবে। (১০) যিনি জয়ী হবেন তিনিই মোট পঞ্চান্ন হাজার টাকার অধিকারী হবেন। (১১) এছাড়াও শকুন্তলা দেবী রাজি হলে তাঁর সঙ্গে আমাকে 'Astrology Vs Science' শিরোনামে একটি আলোচনায় অংশ নিতে হবে। (১২) এই আলোচনার মাধ্যমে কোনওভাবেই কারও পূর্ব ঘোষিত জয়-পরাজয়ের পরিবর্তন হবে না।

আমি প্রতিটি শর্তেই রাজি হলাম। ফলে পরের দিন ৬ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় Evening Brief-এর প্রথম পৃষ্ঠায় চারপাশে বর্ডার দিয়ে বড় বড় হরফে ছাপা হলো "Shakuntala Devi challenged"!

৬ ফেব্রুয়ারি বিকেলেই পত্রিকার তরফ থেকে শকুন্তলা দেবীকে সেদিনের পত্রিকাটি পৌঁছে দেওয়া হয়। ওই দিন সন্ধ্যায় ইভিনিং ব্রিফ ও অন্যান্য কয়েকটি পত্র পত্রিকার তরফ থেকে কিছু সাংবাদিক ও আলোকচিত্রী গ্রেট ইস্টার্ণ হোটেলে হাজির হন চ্যালেঞ্জের মুখে শকুন্তলা দেবীর প্রতিক্রিয়া জানতে। একতলার রিসেপশন কাউন্টার থেকে সাংবাদিকদের বলা হয়, শকুন্তলা দেবীর সঙ্গে দেখা করতে হলে দয়া করে এখান থেকে তাঁকে ফোন করুন। ফোন করেন 'ইভিনিং ব্রিফ' প্রতিনিধি। শকুন্তলা দেবীর এক সহকারিণী জানান - শকুন্তলা দেবী চ্যালেঞ্জের খবরটা পেয়েছেন, কিন্তু ভালোভাবে পড়ে উঠতে পারেন নি। এখন কাস্টমারদের নিয়ে খুবই ব্যস্ত আছেন, পরে তিনি এই বিষয়ে মতামত ও প্রতিক্রিয়া জানাবেন। এখন তিনি কারও সঙ্গেই দেখা করতে পারবেন না। নাছোড়বান্দা সাংবাদিকরা আরও কয়েকবার ফোন করে কয়েকটা মিনিট সময় চাইলেন। সময় মিললো না। শকুন্তলা দেবীকে ফোনটা দেবার অনুরোধ জানালেন 'ইভিনিং ব্রিফ' এর প্রতিনিধি। অনুরোধ রক্ষিত হলো না। ক্রুদ্ধ পত্রিকা প্রতিনিধি রাগে ফেটে পড়লেন। ফোনেই বললেন, "আমাদের কি তবে এমন অদ্ভুত কথাগুলো বিশ্বাস করতে হবে যে, শকুন্তলা দেবী তাঁকে চ্যালেঞ্জ জানানোর খবরটা ভালো করে পড়ার জন্য সময় দেওয়ার চেয়ে খদ্দেরদের ভবিষ্যৎ গোনাকে বেশি প্রয়োজনীয় বলে মনে করেন? আর চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছেন কে? না, র‍্যাশানালিস্ট অ্যাসোসিয়েশনের সেক্রেটারী প্রবীর ঘোষ। প্রবীরবাবু তো স্পষ্টতই অভিযোগ এনেছেন শকুন্তলা দেবীর বিরুদ্ধে যে, তিনি কিছুদিন আগে একটা রেডিও প্রোগ্রামেও প্রবীরবাবুর বিরুদ্ধে বিতর্কে অবতীর্ণ হননি হেরে যাবার ভয়ে। এত বড় একটা ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর তিনি চুপ করে থাকলে এটাই কি আমরা ধরে নেবো না যে, এবারও তিনি ভয় থেকেই প্রবীরবাবুকে এড়াতে চাইছেন?" 

"দুঃখিত, এর জবাব আমরা দিতে পারছি না। আপনাদের সঙ্গে দেখা করিয়ে দিতেও পারছি না।"

"ঠিক আছে, শকুন্তলা দেবীকেই ফোন দিন। তাঁকে শুধু একটা কথাই জিজ্ঞেস করবো, তিনি প্রবীরবাবুর এই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে ইচ্ছুক অথবা অনিচ্ছুক। ইচ্ছুক হলে পরে ডিটেলস্-এ বিভিন্ন ক্লজ এ্যান্ড কন্ডিশন নিয়ে আলোচনা করা যাবে।"

উত্তরে এবার শকুন্তলা দেবীর সহকারিণী জানালেন, "তিনি তো এখন ঘরে নেই। জরুরি ফোন পেয়ে এইমাত্র বেরিয়ে গেলেন। আপ নাদের শুধু এইটুকুই বলতে পারি, শকুন্তলা দেবী তাঁকে চ্যালেঞ্জ জানানোর খবর পেয়েছেন। এই বিষয়ে ফিরে এসে মন্তব্য করবেন।" 

"ওঁকে এখন কোথায় পাওয়া যাবে?"

"তা বলতে পারছি না, তবে এইটুকু বলতে পারি তিনি কলকাতার বাইরে যাচ্ছেন। ফিরবেন সাত-আট দিন পর। তখনই সাংবাদিক সম্মেলন ডেকে এই বিষয়ে মতামত জানাবেন।"

"তাহলে যেসব ক্লায়েন্টরা এই ক'দিনের অ্যাপয়েন্টমেন্ট পেয়েছেন তাঁদের কি হবে?" 

"সব বাতিল করে দেওয়া হলো।" জানালেন সহকারিণী।

সেদিন সন্ধ্যায় আমিও সাংবাদিকদের সঙ্গী হয়েছিলাম। ঘটনাগুলো ঘটেছিল আমারও চোখের সামনে।

না, হোটেলের সামনের পথ ধরে শকুন্তলা দেবী বের হননি। সাংবাদিকদের চোখ এড়াতে পিছনের পথ দিয়ে স্বেচ্ছা নির্বাসনের পথে বেরিয়ে গিয়েছিলেন। বেচারা, তাড়াহুড়োয় হোটেলের বিল মিটিয়ে সহকারিণীটিকে নিয়ে যাওয়ারও সময় সুযোগ পাননি। আর সেই পালানোর সময় পিছনের দরজায় নজর রাখা চিত্র সাংবাদিক কল্যাণ চক্রবর্তীর নজরে পড়ে গিয়েছিলেন। ফলে 'সানন্দা', 'আলোকপাত' সহ বিভিন্ন ভাষাভাষী পত্রিকাতেই চ্যালেঞ্জের মুখে শকুন্তলা দেবীর পলায়নের উত্তেজক খবরের সঙ্গে কল্যাণের তোলা 'স্বেচ্ছা নির্বাসনে শকুন্তলা' ছবিটি প্রকাশিত হয়েছিল। হায়, জ্যোতিষ সম্রাজ্ঞী। আপনিও শেষ পর্যন্ত পারমিতা, অসিত চক্রবর্তী, শুকদেব গোস্বামী ও পাগলাবাবার মতই শুধু পরের অদৃষ্টই বিচার করে গেলেন; নিজের অদৃষ্ট বিচার করতে পারলেন না?

পরের দিনই, অর্থাৎ ৭ ফেব্রুয়ারি দুপুর সাড়ে এগারোটায় আমি গ্রেট ইস্টার্ণ হোটেলে ফোন করি। টেলিফোন অপারেটরকে বলি শকুন্তলা দেবীর ঘরে দিতে। ফোন ধরেন শকুন্তলা দেবীর সহকারিণী; জানান, শকুন্তলা দেবী কলকাতার বাইরে। করে ফিরবেন, বলতে পারছেন না।

এর মাত্র চারদিন আগে অর্থাৎ ৩ ফেব্রুয়ারি সকালে ফোনে শকুন্তলা দেবীর সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলাম। ফোন ধরেছিলেন শকুন্তলা দেবীর সহকারিণী। তাঁকে জানাই, "আমি হিন্দি 'পরিবর্তন' পত্রিকার জন্য একটি সাক্ষাৎকার চাই।" সহকারিণী ফোন দেন শকুন্তলা দেবীকে। শকুন্তলা দেবী যথেষ্ট আন্তরিকতা ও খুশির সঙ্গে আমাকে আসতে অনুরোধ করলেন। সময় দিলেন ৫ তারিখ বিকেল ৪টা ৩০ মিনিট। তারপর অনুরোধ করলেন, আমার নামটি বলতে। বললাম। শুনে বললেন, "আপনি কি র‍্যাশানিলিস্ট অ্যাসোশিয়েশনের প্রবীর ঘোষ?"

বললাম, "হ্যাঁ।"

কিছু বললেন না। ফোনটা নামিয়ে রাখলেন। ৩ তারিখ বিকেলে পরিবর্তন অফিসে গিয়ে জানতে পারলাম, গ্রেট ইস্টার্ণ হোটেল থেকে শকুন্তলা দেবীর পি. এ. ফোন করে জানিয়েছেন, জরুরি কাজে হঠাৎ আটকে পড়ায় ৫ তারিখের অ্যাপয়েন্টমেন্ট শকুন্তলা দেবী ক্যানসেল করতে বাধ্য হয়েছেন। এবার সময়াভাবে আমাকে সাক্ষাৎকার দিতে পারছেন না বলে দুঃখ প্রকাশ করেছেন শকুন্তলা দেবীর তরফে তাঁর পি. এ.। আমি সঙ্গে সঙ্গে ফোন করলাম। শকুন্তলা দেবীকে অনুরোধ জানালাম, "দয়া করে যে কোনও দিন যে কোন সময় মাত্র দশটি মিনিট আমার জন্য খরচ করুন। বাড়তি একটি মিনিট নেবো না। শুধু কয়েকটি প্রশ্ন করে দশ মিনিটের মধ্যেই বিদায় নেবো।"

উত্তরে শকুন্তলা দেবী জানালেন, "যে ক'টা দিন তিনি কলকাতায় থাকবেন, তা ক্লায়েন্টদের অ্যাপয়েন্টমেন্ট এ এতই ঠাসা যে, দশটা মিনিট কেন, পাঁচটা মিনিট সময় বের করাও অসম্ভব।"

সত্যিই শকুন্তলা দেবী এতটাই ঠাসা কর্মসূচীর মধ্যে আছেন কিনা, জানতে পরের দিন অর্থাৎ ৪ তারিখ বেলা ১১টা ৩০ নাগাদ বন্ধু জ্ঞান মল্লিককে দিয়ে ফোন করালাম। শকুন্তলা দেবীর পি. এ.-কে জ্ঞান জানালেন, ভাগ্য গণনা করাতে চান। ৫ ফেব্রুয়ারি দুটো তিরিশে সময় পাওয়া গেলো। জ্ঞান ওই সময় একটা অসুবিধের অজুহাত দেখিয়ে জানালেন, সময়টা সাড়ে চারটে নাগাদ হলে খুবই সুবিধে হতো। পি. এ. একটু ফোনটা ধরতে বলে, তারপর আনালেন, "তাই আসুন।"

বুঝলাম আমাকে এড়াতেই শকুন্তলা দেবী মিথ্যের আড়ালে নিজেকে লুকোতে চাইছেন। ৪, ৫ ও ৬ তারিখ বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন নামে ফোন করে দেখা করার তারিখ পেয়েছিলাম যথাক্রমে ৫, ৬ ও ৭। এই প্রতিটি ঘটনাই শুধু প্রমাণ করে দিচ্ছিল সত্যের মুখোমুখি হতে শকুন্তলা দেবীর তীব্র অনাগ্রহকেই। শকুন্তলা দেবীর মতো প্রচার বিষয়ে অতি সচেতন, তীক্ষ্ণ বুদ্ধির মহিলা স্পষ্টতই বুঝেছিলেন, আমার মুখোমুখি হয়ে অতি কষ্টে তিল তিল করে গড়ে তোলা সাম্রাজ্যকে একদিনে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করার চেয়ে পলায়নের অপমান অনেক বেশি শ্রেয়। বিজ্ঞাপন বেসাতির আড়ালে তাঁর ভাঁওতাবাজী, তাঁর জ্যোতিষচর্চা চালিয়ে যাচ্ছিলেন দীর্ঘকাল ধরে। বছরে সাধারণত অন্তত দু'দফায় কলকাতার হোটেলে জ্যোতিষ ব্যবসা চালাতেন ঢালাও বিজ্ঞাপন ও পত্র পত্রিকায় নানা সাক্ষাৎকারের আড়ালে প্রচার চালিয়ে। '৮৭-র ফেব্রুয়ারিই ছিল তাঁর কলকাতায় বাণিজ্য চালাবার, প্রতারণা চালাবার শেষ বছর। তারপর তিনি আর একটি দিনের জন্যেও কলকাতায় ব্যবসা চালাবার হিম্মত দেখান নি বা আহাম্মকি করেনি।

ভারতবর্ষের বিভিন্ন ভাষাভাষী পত্র পত্রিকায় চ্যালেঞ্জের মুখে শকুন্তলা দেবীর নিশ্চিত পরাজয় এড়াতে পালিয়ে বাঁচার দূর্বল চেষ্টার কথা প্রকাশিত হয়েছে। এমনও হয়েছে, শকুন্তলা দেবী বোম্বাই বা মাদ্রাজের মতো যে বড় শহরগুলোতে গুছিয়ে বসতে গেছেন, সেখানকার স্থানীয় পত্র পত্রিকাগুলোতেই শকুন্তলা দেবীর পালিয়ে বাঁচার চেষ্টার কথা প্রকাশিত হয়েছে। ফলে স্থানীয় সাংবাদিকদের বহু অপ্রিয় প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়েছে। এই সব সাংবাদপত্র, পত্র পত্রিকা ও সাংবাদিকরা যখনই আমার কাছে জানতে চেয়েছেন, আমি ওখানে গিয়ে শকুন্তলা দেবীর মুখোমুখি হতে রাজি আছি কিনা, প্রত্যেককে এবং প্রতিটি ক্ষেত্রে জানিয়েছি - অবশ্যই রাজি। প্রতিটি ক্ষেত্রেই শকুন্তলা দেবী সেই বিতর্কে জড়িয়ে পড়া শহর ছেড়ে পাড়ি জমিয়েছেন অন্য শহরে। শেষ পর্যন্ত তাড়া খেতে খেতে শকুন্তলাদেবী ভারতবর্ষের পাট তুলে দিতে বাধ্য হয়েছেন। 

ডিসেম্বর '৯১তে নিউইয়র্ক থেকে এসেছিলেন বিশিষ্ট বিজ্ঞানী ডঃ রণজিৎকুমার দত্ত। ডঃ দত্ত নিউইয়র্ক থেকে 'Cultural Association of Bengal' কর্তৃক প্রকাশিত একমাত্র বাংলা  পত্রিকা 'সংবাদ বিচিত্রা'র সম্পদক। তিনি আমার কাছে জানতে চেয়েছিলেন শকুন্তলা দেবীর সঙ্গে আমাদের সমিতির পক্ষে আমার গোলমাল প্রসঙ্গে বাড়তি কিছু খবর। 'বাড়তি' বললাম, কারণ নিউইয়র্কে বসেই কিছু ভারতীয় পত্র পত্রিকা পড়ে খবরটা আগেই জেনেছিলেন। জানতে চেয়েছিলেন, এখনও আমি শকুন্তলা দেবীর মুখোমুখি হতে রাজি আছি কিনা? জানিয়েছিলাম, "অবশ্যই। আপনারা আমার যাতায়াত ও থাকা খাওয়ার দায়িত্ব নিলে ওখানে গিয়েই ওঁর মুখোশ খুলে দিয়ে আসবো। আপনারা যে খরচ করবেন, তার কিছুটা আশা করি শোধ করতে পারবো ওখানকার উৎসাহীদের শকুন্তলা দেবীর মতই এক একটি হিউম্যান কম্পিউটার তৈরি করে দিয়ে।"

জানি না, সুদূর নিউইয়র্কেও আক্রান্ত হলে শকুন্তলা দেবী কোথায় পালাবেন। পাঠক-পাঠিকাদের সামনে এই প্রসঙ্গে ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতির প্রধান সম্পাদক হিসেবে স্পষ্ট ঘোষণা রাখছি - শকুন্তলা দেবীর কাছে আমি পরাজিত হলে আমাদের সমিতি সমস্ত শাখা সংগঠন সহ জ্যোতিষ বিরোধী, অলৌকিক বিরোধী সমস্ত রকম কাজকর্ম থেকে বিরত থাকবে। এই কথা আমি লিখছি আমাদের সমিতির একজিকিউটিভ কমিটির মতামত অনুসারে। জানি না, এর পরও শকুন্তলা দেবী আমাদের সমিতির পক্ষে দেওয়া আমার চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করার মতো সততা ও হিম্মত দেখাবেন কিনা?

.................................................................................

একটু অন্য প্রসঙ্গে আসি। শকুন্তলা দেবীর অঙ্ক কষার ক্ষমতার কথা বলায় অনেকেই হয়তো এই প্রসঙ্গে জানতে উৎসাহী হয়ে উঠছেন। তাঁদের উৎসাহ মেটাতে ছোট্ট করে একটু আলোচনা সেরে নিচ্ছি।

শকুন্তলা দেবী কোনও অঙ্ক কষার অনুষ্ঠানে প্রথমেই ঘোষণা করতেন যে, তিনি শুধু অ্যারিথমেটিক কষবেন। ট্রিগনোমেট্রি, অ্যালজেবরা বা ওই জাতীয় কিছু কষবেন না। লগ টেবিল ব্যবহার করতে হয় এমন কোনও প্রবলেমও কষে দেখাবেন না। দেখাবেন যোগ, গুণ, ভাগ, মূল নির্ণয়, কোনও বছরের তারিখের বার নির্ণয় ইত্যাদি। তারপর উপস্থিত দর্শকদের কাছে লিখিত প্রশ্ন চাইতেন এবং উত্তর দিতেন।

শকুন্তলা দেবীর আগেও অনেকেই মুখ মুখে অংক কষার ক্ষমতা দেখিয়েছেন। এঁদের মধ্যে রামানুজন এবং সোমেশ বসুর নাম তো আগেই বলেছি। রামানুজন মুখে মুখেই কষে ফেলতেন কোন যৌগিক সংখ্যা বা কোন দু'টি মৌলিক সংখ্যার গুণফল। এখনও অনেকেই আছেন যাঁরা শকুন্তলা দেবীর মতই সমান দক্ষতা ও দ্রুততায় মুখে মুখে অংক কষতে পারেন। এঁদেরই একজন দিল্লি প্রবাসী মুরারী পাল।

শকুন্তলা দেবী তাঁর মুখে মুখে অংক কষার ক্ষমতার পিছনে কোনও ফর্মুলা বা গোপন সূত্র আছে কিনা সে বিষয়ে মুখ খোলেন না। বরং সমস্ত ব্যাপারটাকে রহস্যময় করে হাজির করেন বলেই অনেকে তাঁকে অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী বলে মনে করেন। শকুন্তলা দেবী বা অন্য যাঁরাই মুখে মুখে বিশেষ ধরনের কিছু অংক কষেন তাঁরা সেগুলি করেন অংকের কিছু সূত্রের সাহায্যে। এই সূত্রগুলো জানা থাকলে এবং কঠোর অনুশীলন করলে ক্লাস সেভেনের রামু শ্যামুও 'হিউম্যান কম্পিউটার' হয়ে উঠতে পারে।

শকুন্তলা দেবী কি ফর্মুলা ধরে অংক কষেন জানি না। তবে আমি একটা ফর্মুলার কথা লিখেছিলাম যার সাহায্যে মুখে মুখেই শকুন্তলা দেবীর মতই অংক কষে ফেলা যায় এবং অভ্যেস করলে অংক কষার সময়ও অবশ্যই কমবে। লেখাটি প্রথম প্রকাশিত হয় 'আলোকপাত' মাসিক পত্রিকার জুলাই, ১৯৮৭ সংখ্যায়। তারপর বহু ভাষাভাষি পত্রিকাতেই ফর্মুলাটি প্রকাশিত হয়েছে। এই খন্ডটিতে অংক শেখাবার অবকাশ নেই। ভবিষ্যতে কোনও বইতে প্রসঙ্গটি আনার চেষ্টা করবো।

- 'অলৌকিক নয়, লৌকিক (৩য়)', প্রবীর ঘোষ




Comments

Popular posts from this blog

শিবিরনামা [পর্ব-এক]

পশ্চিমাদের পুতুল সরকার [পর্ব-এক]

চাড্ডিগণ [এক]