ফ্রয়েড বনাম মার্কসবাদ [পর্ব - এক]

 


ফ্রয়েড এবং ফ্রয়েডপন্থীরা বলে যে, পুরুষরা নাকি ছোটবেলা থেকে মায়েদের ভোগ করার কল্পনা করে এবং বাবার উপস্থিতি এই উদ্দেশ্য সফলের পথে প্রতিবন্ধকতা হিসেবে ধরে নেয়! তাই বিদেশী শাসকেরা দীর্ঘদিন কোন দেশকে শাসন করলে জন্মভূমিকে 'মা' হিসেবে ধরে নিয়ে আন্দোলন সংগঠিত করা হয় এই চিন্তা থেকে যে, তাদের জন্মভূমিকে বিদেশীদের দ্বারা শোষণ প্রক্রিয়া (ফ্রয়েডপন্থীদের দৃষ্টিতে অবচেতন মনে জমে থাকা সম্ভোগের ইচ্ছা) দূর হয়ে যেন তারাই একচ্ছত্রভাবে ভোগের অধিকারী হয়! তাহলে নারীরা কেন স্বাধীনতার সংগ্রামে অংশগ্রহণ করে?

রাজনৈতিক চেতনা সৃষ্টি হওয়ার পিছনেও পুঁজিবাদীদের এই দালালদের হাস্যকর ব্যাখ্যা আছে। পিতৃপ্রধান সমাজে পিতা কর্তৃক নানা কাজে ছোটবেলা থেকে অবদমন এর শিকার হওয়ার কারণে প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পর সমাজ এবং রাষ্ট্রের নানা বিধি-নিষেধকে তারা পিতৃতন্ত্রের প্রতীক হিসেবে ধরে নেয় এবং রাজনৈতিক দল গঠনের মাধ্যমে অরাজকতা তৈরি করে! ফ্রয়েডপন্থীদের মতে রাজনৈতিক সচেতনতা নাকি সুস্থ মস্তিষ্কের লক্ষণ নয়! তাদের কুযুক্তি অনুযায়ী রাজনৈতিকভাবে নিরুৎসাহী তথা নিরপেক্ষ থাকতে হলে রুশ বিপ্লব, চীন বিপ্লব আর দেখা লাগতো না। মেনে নিতে হতো হাজার বছরের পশ্চাৎপদতা। অন্যদিকে আপনি যদি তাদের কুযুক্তি মেনে না নেন, তবে আপনাকে উল্লেখ করা হবে শৈশবের পিতৃ বিদ্বেষী মনোবিকারগ্রস্ত মানুষ হিসেবে।

এছাড়াও আছে Positivism, Existentialism প্রভৃতি বুর্জোয়া দর্শন যেগুলো মানুষকে নৈরাশ্যবাদী করে তোলে। যুক্তি-তর্কের এমন প্যাচের গোলকধাঁধায় ঢুকলে রাজনৈতিক অসচেতন যে কেউ এসব বুর্জোয়া দর্শনের পিছনের সূক্ষ্ম শ্রেণী স্বার্থের দিকটা আবিষ্কার করতে অক্ষম হবে।

ফ্রয়েড তার 'জীবনের দর্শন' নামক প্রবন্ধে মার্কসবাদের পাশাপাশি 'থিওরি অফ রিলেটিভিটি' তত্ত্ব নিয়েও অযৌক্তিক সমালোচনা করেছেন। তিনি বলেছেন থিওরি অফ রিলেটিভিটি তত্ত্ব নাকি বিজ্ঞানকে ধ্বংস করবার কাজে নিয়োজিত এবং বাস্তব বিশ্ব সম্বন্ধে সুনির্দিষ্ট বৈজ্ঞানিক জ্ঞান অর্জন সম্ভব নয়! অন্যদিকে মার্কসবাদ এর সমালোচনা করতে গিয়ে ফ্রয়েড বলেছেন এটা নাকি হেগেলের দর্শনের অবশেষ মাত্র (সামাজিক গড়নের বিবর্তন প্রাকৃতিক ইতিহাসের পরিণাম মাত্র কিংবা সামাজিক স্তরবিন্যাসের ধারা ডায়ালেকটিক পদ্ধতি মেনে চলে)। তাছাড়া মার্কসবাদে শ্রেণী সংগ্রামের যে কথা বলা হয়েছে সেটা নাকি ভ্রান্ত এবং তার মতে ইতিহাসের শুরু থেকে বিভিন্ন মানব গোষ্ঠীর মধ্যে যে সংঘাত তার ফলে বিভিন্ন সামাজিক শ্রেণীর জন্ম হয়েছে। তিনি আরো বলেন এই সংঘাতে যেসব গোষ্ঠী বিজয়ী হয়েছিল তাদের সম্পদ ছিল দুই রকম - মানসিক সম্পদ (জন্মগত আক্রমণ বৃত্তি) আর পার্থিব সম্পদ (ভালো অস্ত্রশস্ত্র)। 

ফ্রয়েড আন্দাজে দাবি করলেন মার্কসবাদ নাকি অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণের উপর জোর দিতে গিয়ে মনস্তত্ত্ব, ঐতিহ্য ইত্যাদি প্রসঙ্গে কথা বলতে ভুলে গেছে। তিনি নিজে যেখানে তার লেখায় স্বীকার করেছেন মার্কসবাদ সম্পর্কে তিনি ভালো জানেন না, সেখানে ঠিকমত না জেনেই বুর্জোয়াদের স্বার্থ উদ্ধারে নেমে পড়লেন। তিনি মার্কসবাদকে ধর্মীয় গোঁড়ামির সাথে তুলনা করলেন। অথচ লেনিন বলেছেন-

"মার্কসের তত্ত্বকে আমরা সম্পূর্ণকৃত ও অলঙ্ঘনীয় একটা কিছু বলে মনে করি না; বরঞ্চ আমরা প্রত্যয়শীল যে তা সেই বিজ্ঞানটির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছে সমাজতন্ত্রীদের যাকে অবশ্যই সকল দিকে বিকশিত করতে হবে, যদি তারা জীবনের সঙ্গে পা মিলিয়ে চলতে চায়।"

(V.I. Lenin, Our Programe, Collected Works, Vol-4, Progress Publishers, Moscow, Page 211)

তিনি দাবি করেছেন বলশেভিকরা নাকি মুক্ত চিন্তার বিরুদ্ধে কড়া হুকুম জারি করেছিল। তাঁর এই ফালতু দাবির অসারতা নিয়ে ব্লগে অনেক লেখা আছে। তিনি আরো বলেছেন বলশেভিকরা নাকি ধার্মিকদের মতো দরিদ্রদের সোনালী ভবিষ্যতের আশ্বাস দিয়ে বলে - পূর্ণ সাম্যাবস্থা প্রতিষ্ঠিত হলে সকল অভাব আর দুঃখ-কষ্ট দূর হয়ে যাবে। অথচ এই মহান বিপ্লবীরা পরকালের অসারতা এক পাশে সরিয়ে রেখে দুনিয়ার বুকেই সেটা প্রায় প্রতিষ্ঠিত করে দেখালেন।

ফ্রয়েডপন্থী আর্নস্ট জোন্স 'আন্তর্জাতিক মানসিক স্বাস্থ্য সম্মেলন' এ বলেছিলেন-

"রুশ জনগণের মনে এমন যে উৎকণ্ঠার জের তার কারণ হলো ওদের মনে অত্যন্ত ব্যাপকভাবে এক পাপবোধের উৎপাত।"

তাঁর মতে এই পাপবোধ "পিতৃ হত্যার মহাপাপ" থেকে সৃষ্ট। ওরা ওদের 'ছোট্ট পিতা জার'কে খুন করেছে। তাহলে তিনি রাজা চার্লসকে হত্যার জন্য ইংরেজদের মাঝে কিংবা মুসোলিনিকে হত্যার জন্য ইতালিয়ানদের মাঝে তথাকথিত 'পাপবোধ' দেখতে পেলেন না কেন?

https://iskrathespark.blogspot.com/2024/11/blog-post_5.html?m=1

ফ্রয়েডপন্থীদের লেখায় যুদ্ধের দৃষ্টিকটু প্রচারও চোখে পড়ার মতো। তাদের মতে মানব মনের জিঘাংসাই নাকি মানুষের প্রাথমিক সহজবৃত্তি। এজন্যই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মার্কিনিরা নিজেদের উদ্যোগে ফ্রয়েডবাদের এতো বেশি প্রচারণা চালিয়েছিল।

Comments

Popular posts from this blog

শিবিরনামা [পর্ব-এক]

পশ্চিমাদের পুতুল সরকার [পর্ব-এক]

চাড্ডিগণ [এক]